পশুপাখিবাহী রোগ
| পশুপাখিবাহী রোগ | |
|---|---|
| প্রতিশব্দ | Zoönosis |
| একটি আক্রান্ত কুকুর | |
| উচ্চারণ | |
| বিশেষত্ব | সংক্রমণ রোগ |
পশুপাখিবাহী রোগ মূলত একধরণের সংক্রামক রোগ যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস কিংবা শৈবালের আক্রমণে হয়ে থাকে। এগুলো নানা ধরনের প্রাণী থেকে মানুষের মাঝে ছড়ায়।
বর্তমানের মারাত্মক রোগ যেমন ইভোলা ও স্যামোনেল্লোসিস হলো পশুপাখিবাহী রোগ। এইডসও একসময় পশুপাখিবাহী রোগ ছিল যেটি ২০শতাব্দীর দিকে মানব শরীরে প্রবেশ করে। বর্তমানে এইডস শুধু মানব শরীরেই হয়। যে ইনফ্লুয়েঞ্জা মানুষকে আক্রান্ত করে তা মূলত মানুষের রোগ কিন্তু বার্ড ফ্লু এবং সোয়াইন ফ্লু পশুপাখিবাহী রোগ; এই ভাইরাসগুলো নানা সময় মানুষের ফ্লুর সাথে মিলিত হয়ে ঝুঁকি তৈরি করে যেমন ১৯১৮ স্প্যানিশ ফ্লি বা ২০০৯ সোয়াইন ফ্লু। পশুপাখিবাহী রোগ বিভিন্ন উপায়ে হতে পারে যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং শৈবাল। বেশিরভাগ মানব রোগ অন্য প্রাণীতে উৎপন্ন হয়েছে।
পশুপাখিবাহী রোগ ছড়ানোর বিভিন্ন উপায় রয়েছে। সরাসরি উপায়ে, পশুপাখিবাহী রোগটি কোন মাধ্যম যেমন বায়ু, স্যালিভা বা কামড় দ্বারা অন্য প্রাণী থেকে সরাসরি মানব দেহে প্রবেশ করে। যখন মানুষ অন্য প্রাণীকে আক্রান্ত করে তখন তাকে বিপরীত পশুপাখিবাহী রোগ বলা হয়। এই রোগের ইংরেজি শব্দটি এসেছে গ্রীক ভাষা থেকে: ζῷον জুন "প্রাণী" এবং νόσος নসস "রোগ"।
কারণ
পশুপাখিবাহী রোগ যেকোন জায়গায় হতে পারে যেখানে প্রাণী বা প্রাণীজ পণ্যের সাথে মানুষের পোষাপ্রাণী হিসেবে, অর্থনৈতিক কারণে (চাষাবাদ), শিকারের কারণে বা গবেষণার জন্য সংস্পর্শ রয়েছে।
খাবার ও পানিতে ভেজাল
সবচেয়ে ভয়াবহ পশুপাখিবাহী রোগ সংক্রামক জীবাণু হলো "এস্কেরিশিয়া কোলি" ০১৫৭ঃএইচ৭, "ক্যাম্পিলোব্যাক্টার", "ক্যালিসিভিরিডে" এবং "সালমোনেল্লা"।
২০০৬সালে, খাদ্যের নিরাপত্তার জন্যে পশুপাখিবাহী রোগ সংক্রামক জীবানুর প্রভাব সম্পর্কে বার্লিনে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
নানা খাদ্যের সংক্রমনের সাথে পশুপাখিবাহী রোগ সংক্রমক জীবানুর সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে। যেসকল খাবারের উৎস বিভিন্ন প্রাণী সেসকল নানা খাবার নানাভাবে জীবাণুতে আক্রান্ত হতে পারে। কিছু সাধারণ খাবার হলো ডিম, সামুদ্রিক খাবার, মাংস, দুগ্ধজাত খাবার এবং কিছু শাক-সবজি।
কৃষি এবং পশু পালন
পশুদের সাথে সংযোগ কৃষকদের মাঝে রোগ সৃষ্টি করতে পারে বা অন্যান্যদের মাঝে যারা পশুর সংস্পর্শে আসে। "গ্ল্যান্ডার" সাধারণত তাদেরকে আক্রান্ত করে যারা ঘোড়া ও গাধার সংস্পর্শে আসে। বিড়ালের খুব সংস্পর্শে আসলে এনথ্রাক্স সংক্রমণ হতে পারে।
প্রদর্শনী
পশুপাখিবাহী রোগের প্রাদুর্ভাব যাচাই করলে দেখা যায় মানুষের সাথে অন্যান্য পশুর মিলন হয়ে থাকে নানা মেলায়, চিড়িয়াখানায় এবং অন্যান্য আয়োজনে। ২০০৫ সালে, রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র জনসাধারণ কার্যক্রমে কীভাবে পশুপাখিবাহী রোগ এড়ানো যায় সেটির পরামর্শ দিয়ে নতুন একটি তালিকা প্রকাশ করে। এই পরামর্শগুলোর মাঝে রয়েছে, মিলনস্থল পরিচালকদের দায়িত্ব, জনসাধারণ এবং পশুদের সংস্পর্শ কমানো, এবং পশুদের যত্ন নেয়া ও ব্যবস্থাপনা করা।
বন উজাড়
লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রধান কেইন জোনস জানান, পশুপাখিবাহী রোগ জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের আচরণের সাথে সম্পর্কিত। বন জঙ্গল ধ্বংস করা, খনন করা, গণ নগরায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানুষকে সকলের নিকটে নিয়ে আসছে যাতে মানুষ প্রাণীর সংস্পর্শে আসছে পূর্বে যা ছিলনা।
বন্য প্রাণীর আক্রমণ
পোষা প্রাণী
পোষা প্রাণীগুলো নানাধরনের রোগ ছড়াতে পারে। কুকুর এবং বিড়ালকে জলাতঙ্কের জন্য নিয়মিত প্রতিষেধক দেয়া হয়। পোষা প্রাণীরা দাদও ছড়াতে পারে, যা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্যই ভয়াবহ। টক্সোপ্লাসমোসিস হলো বিড়ালের একটি সাধারণ রোগ, এটি মানুষের দেহে ছোট রোগ কিন্তু গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এটি ভয়াবহ হতে পারে।
জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়া এবং পরিবেশের ক্ষয়
রয়্যাল সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ২০২০ সালের এপ্রিলের একটি সমীক্ষায় পাওয়া যায়, প্রাণী থেকে মানুষের মাঝে ভাইরাস ছড়ানোর পেছনে জীববৈচিত্র্য হ্রাস ও প্রকৃতির মানের সম্পর্ক রয়েছে। কেননা মানুষ কৃষি কাজ, শিকার ও সম্পদ আহরণের জন্য বনভূমিতে গিয়ে থাকে। সেখানে তারা এমন অনুজীবের সম্পর্কে আসে যেগুলো হয়তো সেখানেই থাকতো। এমন ভাইরাসের ছড়ানো ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি দশকেই হয়ে থাকে।
ওষুধে ব্যবহার
স্মলপক্সের জন্য এডওয়ার্ড জেনার ১৮০০সালে প্রথম যে ওষুধ তৈরি করেছিলেন সেটি ছিল পশুপাখিবাহী রোগের জন্য দায়ী বোভিন ভাইরাস থেকে, সেটি একধরনের রোগ সৃষ্টি করেছিল যার নাম কাউপক্স। জেনার খেয়াল করেছিল যে গোয়ালাদের স্মলপক্স প্রতিরোধ করতে পারতো। জেনার 'কাউপক্স' থেকে এক ধরনের সংক্রামক পায় যা মানুষকে স্মলপক্সের বিপরীতে প্রতিরোধ করে। যার ফল স্বরুপ, সারা বিশ্বে ঐ রোগটি লোপ পায় এবং এটির ব্যাপক ব্যবহার হয় ১৯৮১সালে।
মহামারী
ইবোলা
২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাস খুবই মহামারী রূপ লাভ করে। এটি খুবই সংক্রামক একটি রোগ। মূলত আফ্রিকার কিছু দেশ, যেমন; গিনি, লাইবেরিয়া, সিয়েরাতে এটির প্রভাব বেশি দেখা যায়। সেসময় এটিতে আক্রান্তদের প্রায় ৭০% লোক এটিতে মারা যায়।
করোনাভাইরাস
২০২০ সালে করোনাভাইরাস নামক একটি ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করে। এটি একটি পশুপাখিবাহী রোগ যেটি পশু থেকে মানুষের মাঝে এসেছে। এই ভাইরাস এতোটাই ছোঁয়াচে যে লাখো মানুষ এতে আক্রান্ত হয় এবং সারা বিশ্বে মহামারী দেখা দেয়। করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়। তবে অনেকের সন্দেহ যে এই ভাইরাসটি চীন সরকার তার দেশের গরিব জনগনকে শেষ করে দেওয়ার জন্য নিজেরাই তৈরি করে নিজেরাই ছড়িয়ে ছিলো। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে এসএআরএস-সিওভি-২’ পাওয়া যায়(যা বর্তমানে সাধারণত নোভেল করোনাভাইরাস নামেই পরিচিত। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রামণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯-এনসিওভি’ নামকরণ করে। ২০২০ সালের ১৪ই মে পযন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ২১৩টিরও বেশি দেশ ও অধীনস্থ অঞ্চলে ৪৪ লাখ ৮০ হাজার-এরও বেশি ব্যক্তি করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন বলে সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। বর্তমানে ৩ লাখ -জনের বেশি ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে এবং ১৬ লাখ ৮৪ হাজার এর- বেশি রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছে। এই ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশে লকডাউন জারি করা হয়।
ইতিহাস
অনেক আধুনিক রোগ, এমনকি মহামারী রোগগুলোও পশুপাখিবাহী রোগ দ্বারা শুরু হয়েছে। নতুন পশুপাখিবাহী রোগের জীবাণু বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের সাথে বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শ বৃদ্ধি। এটি হতে পারে বন্যপ্রাণীদের এলাকায় মানুষের বাস করার মাধ্যমে বা বন্যপ্রাণীদের মানুষের এলাকায় বাস করার মাধ্যমে। এটির একটি উদাহরণ হলো ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ায় নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, যখন পলান করা শুকোরেরা আক্রান্ত বাঁদুড়ের সংস্পর্শে আসে। এই ভাইরাসটি কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।
একইভাবে, ২০১৯ সালে চীনে করোনা ভাইরাস দেখা দেয়। যেটি মানবদেহে খুবই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন শুকরের মাংস খাওয়ার মাধ্যমেই এটি মানবদেহে প্রবেশ করেছে। এটি এক মানবদেহ থেকে অন্য মানবদেহে খুবই সহজে ছড়িয়ে পড়ে অন্য মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাস একটি মাহামারী রূপ ধারণ করে যেটিতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়।
পশুপাখিবাহী রোগ কৌতূহলের বিষয় কারণ প্রায়ই এমন রোগ দেখা দেয় যেগুলো পূর্বে কখনোও হয়নি। ওয়েস্ট নিলে ভাইরাস ১৯৯৯ সালে যুকৃতরাজ্যে দেখা দেয় এবং ২০০২সালের গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত এটি সারা দেশে ছড়িয়ে যায়, যা আরও বেশি বেদনাদায়ক।
স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে যারা
পশুপাখিবাহী রোগ যে কারও হতে পারে, এমনকি স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিরও। কিন্তু কিছু লোকের এই রোগের ঝুঁকি বেশি। নিম্নের দলের লোকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি:
- পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের
- প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে যারা তাদের
- যেসকল মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম
- গর্ভবতী মহিলা
সতর্কতা
যেসকল মানুষ পশুকে নিয়ে কাজ করে তাদেরকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সতর্কতার মাঝে রয়েছে:
- ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি: পশু ধরার পরে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। তাছাড়া, খাবার খাওয়া ও ধূমপান করার পূর্বেও হাত ধুতে হবে। অপরিষ্কার হাত নিজের বা অন্য কারও মুখে দেয়া যাবে না।
- স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাদ্য তৈরি: সঠিকভাবে খাবার বানানো ও পরিবেশনের মাধ্যমে বিশাল পরিমাণ রোগ থেকে বাঁচা যায়।
- ব্যক্তিগত সুরক্ষা: পশু পালনের সময় গ্লাভস, এপ্রোণ ও বুট পরিধান করতে হবে। কাঁটা বা ক্ষত স্থানকে পানিরোধক কাপড় দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে।
- প্রাণীর স্বাস্থ্যসুরক্ষা: প্রাণীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা ও প্রাণীকে নানা প্রতিষেধক দেওয়ার মাধ্যমে পশুপাখিবাহী নানা রোগ থামানো যায়।