Мы используем файлы cookie.
Продолжая использовать сайт, вы даете свое согласие на работу с этими файлами.

শিল্পকলার শাখাসমূহ

Подписчиков: 0, рейтинг: 0
হান্স রটেনহ্যমার, অ্যালগরি অব দা আর্টস (১৬শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে)। জেমালদেগালেরি, বার্লিন।

এই নিবন্ধে প্রধান কিছু শিল্পকলার শাখা আলোচনা করা হয়েছে। শিল্পকলা বলতে বিশ্বের বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিদ্যমান বহুবিধ কিছু মানব কর্মকাণ্ডকে বোঝায়, যেগুলিতে দেখা, শোনা বা পড়ার যোগ্য কিংবা পরিবেশন করার মতো এমন বিশেষ কোনও কিছু (বস্তু, পরিবেশ বা অভিজ্ঞতা) সৃষ্টি করা হয়, যার মাধ্যমে সৃষ্টিকারীর কল্পনাশক্তি বা কারিগরি দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং দর্শক, শ্রোতা বা পাঠক বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ও বুদ্ধি দিয়ে মানসিকভাবে যার সৌন্দর্য ও আবেগ উদ্রেককারী ক্ষমতার তারিফ করে। শিল্পকলায় সৃষ্ট বস্তুকে শিল্পকর্ম বলে এবং যে ব্যক্তি শিল্পকলার চর্চা করে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন, তাকে শিল্পী বলে। কোনও মানব কর্মকাণ্ড ও তার সৃষ্টিকে শিল্প বলে গ্রহণ করা হবে কি না, তা প্রায়শই স্থান, কাল, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সম্প্রদায় এমনকি ব্যক্তিগত সৌন্দর্যবোধ ও আবেগ-অনুভূতির উপরে নির্ভর করে। আবার স্থান, কাল, সংস্কৃতির সীমানা ছাড়িয়ে সিংহভাগ মানুষের সৌন্দর্যবোধ ও আবেগকে নাড়া দেয়, এমন শিল্পকর্মও রয়েছে। তবে বিংশ শতাব্দীতে এসে আবেগ ও সৌন্দর্যের চিরায়ত সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে সমসাময়িক শিল্পীসমাজ, শিল্পের সমালোচক ও বোদ্ধাসমাজ এবং শিল্পকর্ম ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দ্বারা সমাদৃত যেকোনও কিছুকেই শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হতে পারে, যা সাধারণ জনগণের কাছে দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। শিল্পকলামূলক কর্মকাণ্ডের পরিধি সতত পরিবর্তনশীল। নতুন প্রযুক্তি, নতুন উপাদান, নতুন পরিবেশ-পরিস্থিতি, ইত্যাদি নতুন নতুন শিল্পকলার জন্ম দিচ্ছে।

শিল্পকলার প্রধান শাখাগুলি হল দৃশ্যকলা (যার প্রশাখাগুলির মধ্যে স্থাপত্য, মৃৎশিল্প, রেখাঙ্কন, চিত্রাঙ্কন, চলচ্চিত্র নির্মাণ, আলোকচিত্রকলাভাস্কর্য অন্তর্ভুক্ত), শোভাবর্ধক কলা, ব্যবহারিক কলা, সাহিত্যকলা (যার প্রশাখাগুলির মধ্যে কল্পকাহিনী, নাটক, কবিতাগদ্য অন্তর্ভুক্ত) ও পরিবেশন কলা (যার প্রশাখাগুলির মধ্যে নৃত্য, সঙ্গীত, মঞ্চনাটক অন্তর্ভুক্ত)। এছাড়া রন্ধনকলাকেও শিল্পকলার একটি শাখা হিসেবে গণ্য করা যায় (যার মধ্যে রন্ধন, চকোলেট প্রস্তুতি, দ্রাক্ষাসুরা প্রস্তুতি, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত)। শিল্পকলার কিছু শাখা-প্রশাখায় দৃশ্যমান উপাদানের সাথে পরিবেশন (যেমন চলচ্চিত্রগ্রহণ) কিংবা অঙ্কনের সাথে লিখিত বিষয়বস্তুর (যেমন কমিক্স) সমন্বয় ঘটানো হয়। প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র থেকে আধুনিক যুগের চলচ্চিত্র পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই শিল্পকলা মানুষের সাথে তার পরিবেশের সম্পর্ককে গল্প বলার ছলে প্রকাশ করার একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে।

দৃশ্যকলা

ললিতকলা (চারুকলা)

যেসমস্ত শিল্পকলাতে ব্যবহারিক উদ্দেশ্য মাথায় না রেখে শুধুমাত্র নান্দনিক বা সৌন্দর্যমূলক কারণে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করা হয়, তাদেরকে ললিতকলা বা চারুকলা বলে। এগুলির মধ্যে আছে রংচিত্র অঙ্কন, রেখাঙ্কন, ভাস্কর্য, ছাপচিত্র, ইত্যাদি।

চিত্রাঙ্কন (রংচিত্র অঙ্কন)

বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের অঙ্কিত তৈলচিত্র মুক্তিযোদ্ধা

কোনও ধারণা বা অনুভূতি নান্দনিকভাবে প্রকাশের জন্য কোনও সমতল পৃষ্ঠতলে তুলি, আঙুল বা অন্য কোনও সরঞ্জামের সাহায্যে এক বা একাধিক রঙ পাতলা স্তরের মতো প্রয়োগ করে বা লেপন করে শুকিয়ে চিত্র অঙ্কন করাকে রংচিত্র অঙ্কন বা সংক্ষেপে চিত্রাঙ্কন (Painting) বলে। রংচিত্র অঙ্কন এক ধরনের দ্বিমাত্রিক দৃশ্যকলা, অর্থাৎ এটির উল্লম্ব দৈর্ঘ্য ও অনুভূমিক প্রস্থ, শুধুমাত্র এই দুইটি মাত্রা রয়েছে এবং এটিকে চোখ তথা দর্শনেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে উপভোগ করতে হয়। রংচিত্র অঙ্কনে আকৃতি, রেখা, রঙ, রঙের আভা বা মাত্রা, বুনট, ইত্যাদি উপাদানগুলিকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবহার করে, এগুলিকে নির্দিষ্ট সজ্জায় বিন্যস্ত করে, এগুলির সমন্বয় সাধন করে ও এগুলিকে গ্রন্থনা করে (গেঁথে) কোনও দ্বিমাত্রিক সমতল পৃষ্ঠে আয়তন, শূন্যস্থান, চলন ও আলোর অনুভূতি ফুটিয়ে তোলা হয় এবং এভাবে কোনও বাস্তব বা পরাবাস্তব ঘটনা উপস্থাপন, কোনও কাহিনীর বিষয়বস্তুর ব্যাখা প্রদান, কিংবা সম্পূর্ণ বিমূর্ত দৃশ্যমান সম্পর্ক সৃষ্টির মত শৈল্পিক অভিব্যক্তিমূলক কাজ সম্পাদন করা হয়।

রংচিত্র অঙ্কন দ্বিমাত্রিক শৈল্পিক অভিব্যক্তির প্রাচীনতম রূপগুলির একটি। মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন যে শিল্পকর্মগুলি পাওয়া গেছে, রংচিত্র তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে, যেমন মিশরের সভ্যতাতে রেখা দিয়ে বিভিন্ন আকৃতি এঁকে তার মধ্যে রঙ লেপন করে দেওয়া হত। গ্রিক সভ্যতার খুব কমসংখ্যক রংচিত্র এখনও টিকে আছে। রোমানরা গ্রিক শিল্প দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, যার প্রমাণ মেলে পোম্পেই এবং হার্কুলেনিয়ামের সূক্ষ্ম প্রাচীরচিত্রগুলিতে।

রংচিত্র অঙ্কন শৈল্পিক অভিব্যক্তির সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় রূপগুলিরও একটি। রংচিত্র অঙ্কনের বহু বিচিত্র শৈলী আছে, যা একেকজন চিত্রকরের নিজস্ব উদ্ভাবন। দর্শন ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিতকারী বিভিন্ন ধর্ম, শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা, ইত্যাদি ব্যাপারে রঙের মাধ্যম, অবলম্বন ও অঙ্কনের কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একজন চিত্রকর রঙের মাধ্যম ও অবলম্বন (support) বিশেষভাবে নির্বাচন করে ও তাঁর নিজস্ব চিত্রাঙ্কন কৌশল প্রয়োগ করে অদ্বিতীয় একটি দৃশ্যমান চিত্রকে বাস্তবে রূপদান করেন।

রংচিত্র অঙ্কনে যে সমতল পৃষ্ঠতলের উপরে রঙ লেপন করা হয়, তাকে ভূমি (Base) বলে। ভূমি যে বস্তুর পৃষ্ঠতল, সেই বস্তুকে অবলম্বন (Support) বলে। অতীতে নিশ্চল অবলম্বন যেমন প্রাচীর বা দেওয়ালের পৃষ্ঠে রংচিত্র অঙ্কন করা হত (প্রাচীরচিত্র বা ম্যুরাল Mural)। বর্তমানে রংচিত্র অঙ্কনে সাধারণত বহনযোগ্য অবলম্বন ব্যবহার করা হয়, যাকে সাধারণভাবে চিত্রকরের পাটা বা ইজেল (Easel) বলা হয়। বহনযোগ্য অবলম্বনকে আবার দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় - প্রসারিত ও অপ্রসারিত। প্রসারিত অবলম্বন বলতে চিত্রকরের পাটার কাঠামোর উপরে টানটান করে বসানো বিশেষ মোটা কাপড় বা পট (ক্যানভাস) বোঝায়। অন্যদিকে অপ্রসারিত অবলম্বন হিসেবে কাঠের বা গুঁড়াকাঠের পাতলা তক্তা (প্যানেল), পলেস্তারা, কাগজ এমনকি কদাচিৎ ধাতুর পাতও ব্যবহার করা হয়। চিত্রাঙ্কনে ব্যবহৃত রঙের মূল উপাদান হল রঞ্জক পদার্থ (সাধারণত প্রাকৃতিক খনিজ পদার্থ থেকে প্রাপ্ত)। রঞ্জক পদার্থকে অন্য একটি মাতৃপদার্থে নিলম্বিত বা আবদ্ধ করে রঙ তৈরী করা হয়, যার সুবাদে রঞ্জক পদার্থটি চিত্রের পৃষ্ঠতলে বা ভূমিতে আটকে থাকে; এই মাতৃপদার্থকে রঙের মাধ্যম (Painting medium বা সংক্ষেপে Medium) বলে। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত রঙের মাধ্যম হল তেল, পানি, টেমপেরা (ডিমের কুসুম বা এ জাতীয় আঠালো প্রলেপসদৃশ পদার্থ), গুয়াশ (পানিতে দ্রবণীয় আঠা জাতীয় পদার্থবিশেষ), সদ্যোরঙ্গ (ফ্রেসকো), মিনা (এনামেল) ও অ্যাক্রিলিক (কৃত্রিম আঠালো প্রলেপ জাতীয় পদার্থ)। রঙের মাধ্যমভেদে রঞ্জক পদার্থের বিভিন্ন ধর্ম যেমন স্বচ্ছতা বা ঔজ্জ্বল্য কমবেশি হয়ে থাকে।

রংচিত্র অঙ্কনের সবচেয়ে প্রচলিত কিছু ধরন বা শ্রেণী হল সদ্যোরঙ্গ চিত্রাঙ্কন (ফ্রেস্কো Fresco), যেখানে পানিতে দ্রবণীয় রঙ ভেজা পলেস্তারায় লেপন করে শুকাতে দেওয়া হয়; তৈলচিত্র অঙ্কন, যেখানে রঞ্জক পদার্থ ধীরে ধীরে শুকাতে থাকা তেলের মধ্যে নিলম্বিত থাকে; টেম্পেরা চিত্র অঙ্কন, যেখানে রঞ্জক পদার্থ ডিমের কুসুম বা ঐরূপ আঠালো প্রলেপ জাতীয় পদার্থে নিলম্বিত থাকে; এবং জলরঙ চিত্র অঙ্কন, যেখানে রঞ্জক পদার্থ পানিতে নিলম্বিত থাকে।

রেখাঙ্কন

ওলন্দাজ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভানগখের অঙ্কিত রেখাচিত্র ছিন্নমস্তক বার্চ বৃক্ষসারি(১৮৮৪)

রেখাঙ্কন বলতে শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশের লক্ষ্যে কোনও পৃষ্ঠের উপরে, সাধারণত কোনও সমতল পৃষ্ঠের উপরে (যেমন কাগজ) রেখা জাতীয় দাগ কাটার মাধ্যমে কোনও কিছুর আকৃতি ফুটিয়ে তোলাকে বোঝায়। সাধারণত পেনসিল (গ্রাফাইট), কলম (কালি), কাঠ-কয়লা কিংবা চকখড়ি দিয়ে রেখাঙ্কন করা হয় এবং একাধিক রঙ ব্যবহার করা হয় না। রেখার পাশাপাশি বিশেষ পদ্ধতিতে ঘষে ঘষে আলোছায়ার আভাও ফুটিয়ে তোলা হতে পারে। রেখাঙ্কনের বিষয়বস্তু বাস্তব জীবনের দৃশ্যমান কোনও বস্তু, মনের চোখে দৃশ্যমান কাল্পনিক কোনও বস্তু, কিংবা সম্পূর্ণ যাদৃচ্ছিক বা বিমূর্ত কোনও আকৃতির বস্তু হতে পারে। রেখাঙ্কনের মাধ্যমে ধারণা, চিন্তা, আবেগ-অনুভূতি, অলীক কল্পনা, প্রতীক, ইত্যাদি সবই প্রকাশ করা যেতে পারে। রেখাঙ্কনে রূপ (form) বা আকৃতির (shape) উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়, উল্টোদিকে রঙচিত্র অঙ্কনে রঙ (colour) ও পিণ্ডীভবনকে (mass) প্রাধান্য দেওয়া হয়। রেখাঙ্কনে ছাপচিত্রের মতো গণ-উৎপাদনের ব্যাপারটি মাথায় রাখা হয় না। রেখাঙ্কন অন্য সমস্ত দৃশ্যকলার ধারণাগত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। একজন স্থপতি যখন ভবনের নকশা করেন কিংবা একজন ভাস্কর যখন পাথর বা অন্য উপকরণের উপরে দাগ কাটেন, সেগুলিকে এক ধরনের প্রাথমিক রেখাঙ্কন হিসেবে গণ্য করা যায়। বেশির ভাগ দেয়ালচিত্র বা রঙচিত্রের পেছনেই প্রাথমিক খসড়া রেখাঙ্কন থাকে, যাতে চিত্রকর তাঁর শৈল্পিক চিন্তাভাবনাগুলি মোটা দাগে প্রকাশ করেন। তবে এই সব ক্ষেত্রেই রেখাঙ্কনের ভূমিকা ছিল গৌণ; একবার ভবনের নকশা, ভাস্কর্য বা রঙচিত্র নির্মাণ শুরু হয়ে গেলে আদি রেখাচিত্রটি বর্জন করে দেওয়া হত। পাশ্চাত্যে ১৪শ শতকে এসে রেখাঙ্কন আলাদা স্বতন্ত্র একটি দৃশ্যকলার ধারা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, যেখানে মোটা দাগের খসড়া নয়, বরং সূক্ষ্ম বিবরণ ও দ্যোতনাবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ একটি শিল্পকর্ম সৃষ্টি ছিল মূল লক্ষ্য।

ভাস্কর্য

ফরাসি ভাস্কর ওগ্যুস্ত রোদাঁ'র সৃষ্ট ভাস্কর্য ল্য পঁসর "ভাবুক"

ভাস্কর্য নির্মাণ দৃশ্যকলার একটি শাখা যেখানে ঐতিহ্যগতভাবে শক্ত বা নমনীয় উপাদান-পদার্থকে নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দিষ্ট নকশা অনুযায়ী আকার, আকৃতি ও আয়তন প্রদান করে ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মে রূপান্তরিত করা হয়। ভাস্কর্য নির্মাণকারী শিল্পীকে ভাস্কর বলে এবং উৎপাদিত শিল্পকর্মটিকে ভাস্কর্য বলে। ঐতিহ্যগতভাবে ভাস্কর্য সাধারণত দুই ধরনের হয়। প্রথমত এটি নিরাবলম্ব ভাস্কর্য হতে পারে, অর্থাৎ কোনও অবলম্বন ছাড়া স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে দণ্ডায়মান একটি শিল্পকর্ম হতে পারে। দ্বিতীয়ত এটি উদ্গত ভাস্কর্য হতে পারে, অর্থাৎ এটি কোনও পৃষ্ঠতল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে বা অবলম্বনরূপী কোনও পৃষ্ঠতলের উপরে বসানো হতে পারে। ভাস্কর্য এমনকি দর্শককে ঘিরে রাখা পরিপার্শ্বস্থ কোনও কিছু হতে পারে। ভাস্কর্য শিল্পে কাঁচামাল বা মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন বিশেষ কাদামাটি, ধাতু, পাথর, কাঠ, মোম, হাতির দাঁত, অস্থি, কাপড়, কাচ, পলেস্তারা, রবার কিংবা বিচিত্র যেকোনও বস্তু। এই উপাদান পদার্থগুলিকে কেটে, কুঁদে, আকার প্রদান করে, ছাঁচে ঢেলে, আঘাত করে, চাপ দিয়ে, সুতায় গেঁথে, জোড়া লাগিয়ে, ধাতু গলিয়ে, একত্রে সন্নিবিষ্ট করে বা অন্য কোনও উপায়ে সংযুক্ত করা হয় ও আকার-আকৃতি-আয়তন দান করা হয়। একজন ভাস্কর অভিমুখ, প্রতিসাম্য, অনুপাত, মাপ, সন্ধি, ভারসাম্য, ইত্যাদি মূলনীতিগুলিকে কাজে লাগিয়ে ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।

ভাস্কর্য থেকে চিত্রকর্মের পার্থক্য হল ভাস্কর্য অনেক বেশি বাস্তব ও জীবন্ত। চিত্রকর্মে আলো-ছায়া অঙ্কনের কৌশল ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক স্থানের যে দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টি করা হয়, তা ভাস্কর্যশিল্পে সম্ভব নয়। কেননা ভাস্কর্যশিল্প সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই ত্রিমাত্রিক। ভাস্কর্য একটি দৃশ্যকলাই শুধু নয়, অর্থাৎ এটি কেবল দর্শনেন্দ্রিয় নয়, বরং স্পর্শেন্দ্রিয় তথা ত্বকের দ্বারা স্পর্শ করেও উপভোগ করা সম্ভব। একজন অন্ধ ব্যক্তিও বিশেষ ধরনের ভাস্কর্য সৃষ্টি ও উপভোগ করতে পারেন। কেউ কেউ ভাস্কর্যকে মূলত স্পর্শনীয় কলা হিসেবেই গণ্য করা উচিত বলে মত দেন, কেন না ভাস্কর্য নির্মাণের সাথে স্পর্শের সরাসরি সম্পর্ক আছে। প্রতিটি মানুষ জন্ম থেকেই ত্রিমাত্রিক বিশ্বের বাসিন্দা বিধায় ত্রিমাত্রিক বিশ্বের বিভিন্ন কাঠামো ও এগুলিতে অন্তর্নিহিত অভিব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারে ও প্রতিক্রিয়ামূলক আবেগ অনুভব করার ক্ষমতা রাখে। ভাস্কর্য শিল্পের উদ্দেশ্য মানুষের আবেগের এই জায়গাতে নাড়া দেওয়া ও একে পরিশীলিত করা। ভাস্কর্য প্রকৃতিতে বিদ্যমান কিংবা মানবনির্মিত অসংখ্য আকৃতিকে উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, কিংবা সম্পূর্ণ উদ্ভাবনীমূলক কিছু হতে পারে। ভাস্কর্য জ্যামিতিক আকৃতির পাশাপাশি কোমল, কঠিন, স্থির, গতিময়, টানটান, প্রবহমান, আক্রমণাত্মক, স্বচ্ছন্দ ও নিরুদ্বেগ, ইত্যাদি বিভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে।

২০শ শতকের আগে ভাস্কর্যকে একটি বাস্তবের প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্প হিসেবে গণ্য করা হত, যখন মানুষের রূপ, প্রাণী, নির্জীব বস্তু ইত্যাদির প্রতিমামূলক বা মূর্তিমূলক ভাস্কর্য নির্মাণের চল ছিল। ২০শ শতক থেকে বাস্তবের প্রতিনিধি নয়, এমন সব বিমূর্ত ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু হয়। বর্তমানে ভাস্কর্য কেবল স্থির নয়, চলমানও হতে পারে। ঐতিহ্যগতভাবে বস্তুপিণ্ড ছিল ভাস্কর্যের মূল উপাদান। কিন্তু আজ ভাস্কর্যের অভ্যন্তরীণ শূন্যস্থানকে শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এমনকি শুধুমাত্র শূন্যস্থানের শৈল্পিক বিন্যাসকেও ভাস্কর্য হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া বর্তমানে প্রক্ষিপ্ত আলো দিয়ে গঠিত পদার্থহীন ফাঁপাচিত্র (Hologram) জাতীয় ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মও ভাস্কর্য হিসেবে স্বীকৃত। সমসাময়িক যুগে এসে ভাস্কর্যের সংজ্ঞা পালটে গেছে। বর্তমানে অভিব্যক্তি প্রকাশকারী ত্রিমাত্রিক যেকোনও শিল্পকর্মকে ভাস্কর্য বলা হয়।

ছাপচিত্র

লাইনোলিয়াম পাথরের সমতল পৃষ্ঠে ছবি বা নকশা খোদাই করা হচ্ছে
নকশা কাটা লাইনোলিয়াম পাথরের পৃষ্ঠে কালি লেপনের পরে কাগজে নকশা স্থানান্তর করা হচ্ছে

ছাপচিত্র নির্মাণ বলতে এমন এক ধরনের চারুকলাকে বোঝায় সাধারণত কাগজের উপরে ও কদাচিৎ কাপড়, পার্চমেন্ট (পশুচর্মের) কাগজ, প্লাস্টিক ও অন্যান্য অবলম্বনে বিভিন্ন পুনরুৎপাদনমূলক কৌশল ব্যবহার করে চিত্র ছাপানো হয়। এখানে সাধারণত একজন ছাপচিত্রশিল্পী নিজে কিংবা শিল্পীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তার সহকারীরা কাষ্ঠখণ্ড, ধাতুর পাত বা সমতল প্রস্তরপৃষ্ঠে বিভিন্ন কৌশলে কোনও রেখাচিত্র বা নকশা হাতে এঁকে প্রস্তুত করে, তারপরে সেই পৃষ্ঠতলে কালি লেপন করে, তারপর একটি কাগজের পৃষ্ঠাকে সেই কালি লেপনকৃত পৃষ্ঠতলের উপর চাপ দিয়ে কালি চিত্রটি কাগজে স্থানান্তরিত করে; এভাবে একাধিক কিন্তু সীমিত সংখ্যক হুবহু দেখতে কিছু শিল্পকর্ম মুদ্রিত বা ছাপানো হয়। এরকম সুচারুভাবে নির্মিত ছাপচিত্রগুলির একাধিক নকল থাকলেও প্রতিটিকেই মৌলিক শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়।

ছাপচিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্য হল ইতিমধ্যে বিদ্যমান কোনও চিত্র বা নকশা বহুল সংখ্যায় পুনরুৎপাদন করা। ব্যবহারিক জীবনে টাকা ছাপানোর সাথে এর অনেক মিল আছে। তবে শিল্পকলা তথা চারুকলার দৃষ্টিকোণ থেকে ছাপচিত্রশিল্পী ছাপচিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়াতে তাঁর একান্ত নিজস্ব শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকেন, যাতে বিমূর্ত কিংবা বাস্তবের প্রতিনিধিত্বমূলক কোনও কিছুর বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। ছাপচিত্রকলাতে মূল চিত্রটি কীভাবে সৃষ্টি করা হয়, এবং মূল চিত্রটি থেকে কী উপায়ে অন্য একটি কাগজে ছাপ নেওয়া হয়, তার উপর ভিত্তি করে ছাপচিত্র নির্মাণকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। নতোন্নত (যেমন কাঠ কাটা, লিনোলিয়াম কাটা), অবতক্ষণ (যেমন এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, ড্রাইপয়েন্ট), সমতল লিখন (যেমন প্রস্তরলিখন) ও ছিদ্রময় পর্দা (যেমন রেশমলিখন)।

নতোন্নত ছাপচিত্র (রিলিফ Relief) নির্মাণের সময়ে একটি কাঠ বা লিনোলিয়াম খণ্ডের সমতল পৃষ্ঠ থেকে মূল সাদাকালো চিত্রের সাদা, বর্ণহীন তথা চিত্রহীন অংশটি (Non-image area) কেটে-কুঁদে সরিয়ে নেওয়া হয়। ফলে যে অংশটি উঁচু থেকে যায়, তাকে চিত্রযুক্ত অংশ (Image area) বলে, যাকে কালো বা অন্য বর্ণের কালিতে রঞ্জিত করা হয়; এ কাজে কালিযুক্ত বেলন বা রোলারের সাহায্য নেওয়া হয়। এই কালিযুক্ত পৃষ্ঠের উপরে সাদা কাগজ বসিয়ে গোল, পাতলা পাতের মতো একটি উপকরণ (যাকে ইংরেজিতে ব্যারেন Baren বলে) হাতে ধরে ধীরে ধীরে সমানভাবে কাগজের সর্বত্র চাপ দিয়ে দিয়ে ছাপচিত্রটিকে কাগজে স্থানান্তরিত করা হয়।

অবতক্ষণ পদ্ধতির ছাপচিত্রে (ইন্টালিও Intaglio) মূল রেখাচিত্রের কালো রেখাগুলির একটি অনুলিপি একটি তামা বা দস্তার ধাতুর পাতের এক পৃষ্ঠে সরঞ্জাম বা অ্যাসিড দিয়ে হালকা খোদাই করা হয়, এরপর খোদাইয়ের খাঁজগুলিতে কালি স্থাপন করা হয়, ফলে সেখান থেকে পরবর্তীতে রেখাগুলি তথা সম্পূর্ণ রেখাচিত্রটির একটি ছাপচিত্র সাদা কাগজে স্থানান্তরিত হয়। খোদাই পদ্ধতির ছাপচিত্র নির্মাণ কারিগরি ও জটিল এবং এতে শিল্পীর নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। খোদাই পদ্ধতি বেশ কয়েকটি শাখা আছে, যেমন হালকা ক্ষোদন (এচিং), গভীর ক্ষোদন (এনগ্রভিং), জলীয় আভা (অ্যাকুয়াটিন্ট), অর্ধাভা (মেৎজোটিন্ট) ও শুষ্কবিন্দু (ড্রাইপয়েন্ট)। জলীয় আভা পদ্ধতিতে সূক্ষ্ম ও স্পষ্ট রেখার বদলে জলরঙ চিত্রের মতো রঙের প্রলেপের মৃদু আভা মুদ্রিত করা হয়। শুষ্কবিন্দু পদ্ধতিতে যেখানে শক্ত, ধাতু বা হীরার ধারালো সুঁই দিয়ে ধাতব পাতের উপরে খোদাই করে করে ছবিকে ফুটিয়ে তোলা হয়।

সমতল লিখন (প্লেনোগ্রাফি Planography) তথা প্রস্তরলিখন পদ্ধতির (লিথোগ্রাফি Lithography) ছাপচিত্রে মূল রেখাচিত্র ও বর্ণহীন অংশ কোনও একটি প্রস্তরখণ্ডের একই সমতল পৃষ্ঠে অবস্থান করে। এরপর পাথরের পৃষ্ঠটিকে বিশেষ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চালনা করলে মূল চিত্রের একটি ছাপচিত্র কাগজে স্থানান্তরিত হয়।

ছিদ্রময় পর্দা (স্টেনসিল Stencil) তথা পর্দামুদ্রণ (স্ক্রিন প্রিন্টিং Screen printing) পদ্ধতিতে কোনও পাতলা পাত থেকে নকশা কেটে নেওয়া হয় এবং এই নকশা কাটা ছিদ্রযুক্ত পাতটির উপরে রঙ স্প্রে করে (ছিটিয়ে) বা কালি লেপে ছিদ্রের মধ্য দিয়ে কাগজে নকশাটি স্থানান্তর করা হয়। অতীতে রেশমের পর্দা ব্যবহৃত হত বলে এই পদ্ধতিটিকে রেশমলিখন (সেরিগ্রাফি Serigraphy) নামেও ডাকা হয়।

চারুলিপি

ভারতের তাজমহল স্মৃতিসৌধের দেয়ালে খোদাইকৃত আরবি-ফার্সি চারুলিপি

চারুলিপি এক ধরনের দৃশ্যকলা যেখানে বিশেষ তুলি, কলম ও কালির সাহায্যে কাগজের বা অন্য অবলম্বনের (যেমন রেশমের কাপড়, পাথর, পোড়ামাটি, মোম, কাঠ, ইত্যাদি) উপরে সুন্দর ও সুচারুরূপে কোনও ভাবপ্রকাশমূলক বা যোগাযোগমূলক বিষয়বস্তু হাতে লেখা হয়। যিনি চারুলিপি সৃষ্টি করেন, সেই শিল্পীকে চারুলিপিকর বলে। লিখিত যোগাযোগের পাশাপাশি শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশ ও শোভাবর্ধনের পদ্ধতি হিসেবে চারুকলা ব্যবহৃত হয়। একে "লিপিকলা"-ও বলা হয়। চারুলিপিতে প্রত্যেকটি অক্ষর বা বর্ণের পাশাপাশি সম্পূর্ণ নথির উপরেও প্রযুক্ত হতে পারে। আধুনিক বিপণনের যুগে এসে কোনও পণ্যের "লোগো" অর্থাৎ অক্ষরভিত্তিক প্রতীকের নকশা প্রণয়নেও চারুলিপির ব্যবহারিক গুরুত্ব রয়েছে।

লেখার অবলম্বনের ঢাল (উল্লম্ব, অনুভূমিক বা হেলানো), কাগজের বুনটের সূক্ষ্মতা ও মসৃণতা, লিখন উপকরণ বা কলমের প্রকার, কলমের মোচার বা নিবের প্রশস্ততা, কলমের মোটা বা সরু আঁচড়, হাত দিয়ে কলম ধরার কৌশল, কাগজের পৃষ্ঠের সাথে কলমের মোচা বা নিবের কোণ (Angle), কলমের প্রতিটি আঁচড়ের ক্রম ও প্রবাহ (Ductus), অক্ষরের উচ্চতা (Height), অক্ষরের ঢাল (Slant), প্রতিসাম্য অক্ষ (Axis of symmetry), আবর্তনীয়তা (Rotatibility), আঁচড়গুলি কীভাবে সংযুক্ত হচ্ছে যেমন স্পর্শ (Touch), কাছে আসা (Meet), উপরিপাতন (Overlap) কিংবা অতিক্রম করা (Cross), ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যাপারগুলি চারুলিপিতে গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বের বহু সংস্কৃতিতে চারুলিপির প্রচলন আছে। ইসলামী দেশগুলিতে ক্বালাম নামের বাঁশ বা নলখাগড়া দিয়ে বানানো এক ধরনের কলম দিয়ে আরবি চারুলিপি সৃষ্টি করা হয়, যা খ্রিস্টীয় ৭ম শতক থেকে প্রচলিত। মসজিদের দেয়ালেও আরবি চারুলিপির নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। ভারত, চীন ও জাপানে তুলি দিয়ে চারুলিপি সৃষ্টি করা হয়। এশিয়ার এইসব দেশে বহু শতাব্দী ধরেই চারুলিপি অত্যন্ত সম্মানিত একটি শিল্পকলা। পাশ্চাত্যে প্রথম গ্রিসে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে শোভাবর্ধনের কাজে চারুলিপির ব্যবহার শুরু হয়, রোমানরা এই ধারা বজায় রাখে এবং পরবর্তীতে অন্যান্য ইউরোপীয়রা গ্রিক ও রোমান শৈলীর উপর ভিত্তি করে তাদের নিজস্ব চারুলিপি সৃষ্টি করে। মধ্যযুগ পর্যন্ত বিশ্বের সমস্ত সংস্কৃতিতে সাধারণ মানুষের সিংহভাগই নিরক্ষর ছিল। সে সময় ধর্মীয় লেখকেরা ধর্মীয় গ্রন্থাবলির অনুলিপি করতে ও সেগুলির শোভাবর্ধন করতে চারুলিপির আশ্রয় নিতেন। ১৫শ শতকে ছাপাখানার আবির্ভাবের পরে সরলীকৃত মুদ্রিত অক্ষর বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং মানুষ এগুলির মতো করেই বেশি করে লিখতে আরম্ভ করে। চারুলিপি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে ১৯শ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত চারুলিপির তেমন গুরুত্ব ছিল না। এরপর একটি শৈল্পিক অবসরবিনোদনমূলক শখের কাজ হিসেবে চারুলিপি আবারও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

অন্যান্য দৃশ্যকলা

আলোকচিত্রকলা

মার্কিন ভূদৃশ্য-আলোকচিত্রশিল্পী অ্যানসেল অ্যাডাম্‌সের তোলা আলোকচিত্র ইভনিং, ম্যাকডোনাল্ড লেক, গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক (১৯৪২)

বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে কোনও দৃশ্যকে আলোক-সংবেদী ঝিল্লিতে ধারণ করে পরবর্তীতে সেটিকে চিত্ররূপে বিশেষ কাগজে মুদ্রণ করার প্রক্রিয়াকে আলোকচিত্রগ্রহণ বলা হয়। যন্ত্রটিকে আলোকচিত্রগ্রাহক যন্ত্র বা ক্যামেরা বলে; ফিতার মত ঝিল্লিটিকে ফিল্ম বলে৷ মুদ্রিত চিত্রটিকে আলোকচিত্র বা ফটোগ্রাফ (সংক্ষেপে ফটো) বলে। একই দৃশ্য ফিল্ম থেকে একাধিকবার মুদ্রণ করলে সেগুলিকে একেকটি মুদ্রণ বা প্রিন্ট বলে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে ডিজিটাল ইলেকট্রনীয় আলোকচিত্রগ্রাহক যন্ত্রের আলোক-সংবেদী গ্রাহক পর্দাতে (Sensor) দৃশ্য ধারণ করে সেগুলিকে বৈদ্যুতিক সঙ্কেতে রূপান্তরিত করে ডিজিটাল অর্থাৎ বাইনারি নথি বা ফাইল হিসেবে তড়িৎ-চৌম্বকীয় স্মৃতিতে (মেমরি কার্ড) সংরক্ষণ করে রাখা হয়, পরবর্তীতে কম্পিউটার তথা ইলেকট্রনীয় গণকযন্ত্রে বিশেষ অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে সেই অসদ (virutal) ডিজিটাল আলোকচিত্রটির পরিবর্তন সাধন করা হয়। যে ব্যক্তি আলোকচিত্রগ্রহণ করেন, তাকে আলোকচিত্রগ্রাহক বলে। সাধারণত আলোকচিত্রকে এক ধরনের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যা মানুষ, স্থান, বস্তু ও ঘটনার বিভিন্ন চাক্ষুষ তথ্যের নির্ভরযোগ্য বিবরণমূলক সাক্ষ্য দেয়। যেমন সংবাদপত্রে, প্রশাসনিক নথিতে, শিক্ষার উপকরণে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, চিকিৎসা, ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনা বা ভ্রমণের স্মৃতি হিসেবে, ইত্যাদিতে যে আলোকচিত্রগুলি ব্যবহৃত হয়; এগুলিকে বাস্তবের প্রতিনিধিত্বমূলক আলোকচিত্রগ্রহণ বলা হয়। আবার যদি আলোকচিত্রকে ব্যবসায়িক পণ্য বা সেবার বিজ্ঞাপনী প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়, তাহলে সেই ব্যাপারটিকে বাণিজ্যিক আলোকচিত্রগ্রহণ বলা হয়। এই দুইয়ের বিপরীতে আরেক ধরনের আলোকচিত্রগ্রহণ আছে, যা হল শৈল্পিক আলোকচিত্রগ্রহণ বা আলোকচিত্রকলা। একজন শৈল্পিক আলোকচিত্রগ্রাহক বা আলোকচিত্রশিল্পী সৃষ্টিশীল অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে আলোকচিত্রকে ব্যবহার করেন এবং এর মাধ্যমে তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা, বার্তা বা আবেগ-অনুভূতির নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেন। আলোকচিত্রশিল্পী যে উপাদানগুলি নিয়ে কাজ করেন, সেগুলি হল রেখা (একমাত্রিক), আকৃতি (দ্বি-মাত্রিক), রূপ বা ত্রিমাত্রিক আকৃতি (form), বুনট (texture), বিন্যাস (pattern), রঙের তারতম্য (hue) ও মান (value), ভরাট স্থান ও শূন্যস্থান (positive and negative space), আলো-ছায়া (light), চিত্রগ্রহণের কোণ (angle) বা দৃষ্টিভঙ্গি (perspective), ক্ষেত্রের গভীরতা (depth of field), কাঠামো (frame), ইত্যাদি। তিনি এই উপাদানগুলিকে মাথায় রেখে সুসঙ্গতি (harmony), ঐক্য (unity), অনুপাত (proportion), পুনরাবৃত্তি (repetition), ছন্দ (rhythm), গতি (movement), ভারসাম্য (balance), প্রতিসাম্য (symmetry), গুরুত্ব প্রদান (emphasis), বৈপরিত্য (contrast) ইত্যাদি মূলনীতিগুলিকে প্রয়োগ করে একটি শৈল্পিক আলোকচিত্র রচনা করেন। ২০শ শতকের শুরুতে এসে শিল্পমাধ্যম হিসেবে আলোকচিত্রের বিকাশ ঘটে এবং ২০শ শতকের শেষ প্রান্তে এসে আলোকচিত্রকলা বিশ্বের সেরা আধুনিক শিল্প প্রদর্শনীগুলিতে স্থান করে নেয়।

চলচ্চিত্র গ্রহণ

ক্যামেরার পেছনে একজন চলচ্চিত্রগ্রাহক, পাশে পরিচালক

চলচ্চিত্রগ্রহণ হল বাস্তব বিশ্বের ঘটনা ক্যামেরা নামক যন্ত্রে ধারণ করে চলমান চিত্র রচনা করার কারিগরি শিল্পকলা। চলচ্চিত্রগ্রহণ ছাড়া চলচ্চিত্র তৈরি অসম্ভব। একটি চলচ্চিত্রের বাজেটের সিংহভাগই চলচ্চিত্রগ্রহণের পেছনে খরচ হয়। একজন পাণ্ডুলিপি রচয়িতার কাজ যদি কাহিনী ও সংলাপ লেখা হয়, আর একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের কাজ যদি হয় অভিনেতাদের পরিচালনা করা, তাহলে চলচ্চিত্রগ্রাহকের প্রাথমিক কাজ হল কাহিনী, সংলাপ ও অভিনেতাদের ধারাবাহিকভাবে চলমান আলোকচিত্র হিসেবে ধারণ করা। তবে চলচ্চিত্রগ্রহণ কেবলমাত্র কোনও মঞ্চে বা অবস্থানে কী ঘটছে, তা নিষ্ক্রিয়ভাবে ক্যামেরার ফিতায় বা সেন্সরে ধারণ করাতেই সীমাবদ্ধ নয়। দর্শকরা ছবির কাহিনী, পটভূমি, অভিনেতার কার্যকলাপ ও কথোপকথন কীভাবে দেখবেন - এই গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিগত ব্যাপারগুলি চলচ্চিত্রগ্রহণের অংশ। চলচ্চিত্রগ্রহণ চলচ্চিত্রের কাহিনীকে কেবল সমর্থনই করে না, বরং ক্যামেরার অবস্থান, ক্যামেরার সঞ্চালন, ক্যামেরার কোণ, ক্যামেরার দৃষ্টি নিবদ্ধকরণ, আলোকসম্পাত, দৃশ্য রচনা ও সংগঠন, ধারণকৃত দৃশ্যের পরিকাঠামো, ক্যামেরার লেন্স বা পরকলার এবং অন্যান্য সরঞ্জাম পছন্দ করা, ধারণকারী ফিতা বা ডিজিটাল মাধ্যম (সেন্সর) পছন্দ করা, ক্ষেত্রের গভীরতা, দৃশ্যকে কাছে বা দূরে নিয়ে আসা (জুম), রঙ, আলোর প্রবেশ্যতা (এক্সপোজার), ছাঁকন, বিশেষ দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টি, ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে দর্শকের মনে বিশেষ আবহ ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ চলচ্চিত্রগ্রাহক ছবির ভাষায় চলচ্চিত্রের কাহিনীটিকে উপস্থাপন করেন। একজন চলচ্চিত্রগ্রাহককে অনেক সময় আলোকচিত্রগ্রহণ পরিচালকও বলা হয়ে থাকে। তিনি চলচ্চিত্রটিকে পর্দায় দেখতে কেমন লাগবে এবং দেখার পরে দর্শকের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থেকে সমস্ত দৃশ্যমান উপাদানগুলির উপরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দৃশ্যগুলির মধ্যে সমন্বয়, সুসামঞ্জস্য, পুনরাবৃত্তি, একতা, মসৃণ দৃশ্যান্তর, ইত্যাদি ব্যাপারগুলিও তার মাথায় থাকে। তার অধীনে ক্যামেরাচালকদের দল ও আলোকসম্পাতকারীর দল কাজ করে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি চলচ্চিত্রের পরিচালকের সাথে একত্রে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে থাকেন। তিনি পরিচালককে চলচ্চিত্রের দৃশ্যগত মান উন্নত করার ব্যাপারে বিশেষ পরামর্শ দেন এবং একই সাথে পরিচালক কল্পনায় যেভাবে চলচ্চিত্রটি দেখছেন, সেই দর্শনটিকে চলচ্চিত্রের প্রতিটি দৃশ্যে বাস্তবিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেন। এছাড়া তিনি মঞ্চসজ্জা পরিচালক ও অবস্থান (লোকেশন) পরিচালকের সাথে মিলে পটভূমির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন।

সচল চিত্রনির্মাণ (অ্যানিমেশন)

একজন ছাত্র সচল চিত্রনির্মাণ (অ্যানিমেশন) কর্মশালায় কাজ করছেন

মিশ্রমাধ্যম কলা

সংস্থাপন (ইনস্টলেশন)

সাঁটা (কোলাজ)

সন্নিবেশ

পরিবর্তিত গ্রন্থ

ভেজা ও শুকনো মাধ্যম

শোভাবর্ধক কলা

বস্ত্র ও তন্তু

বস্ত্রবয়ন কলা

তন্তু কলা

তাপিশ্রী (বুটিদার বা চিত্রিত পর্দা বয়ন)

একজন শিল্পী তাপিশ্রী বা চিত্রিত পর্দা তৈরি করছেন
প্যারিসের লুভ্র জাদুঘরে রক্ষিত জামার যুদ্ধ, ১৭শ শতকে বয়নকৃত তাপিশ্রী বা চিত্রিত পর্দা

তাপিশ্রী তথা চিত্রিত পর্দাবয়ন বলতে হস্তচালিত তাঁত দিয়ে বোনা বস্ত্রভিত্তিক বড় মাপের দৃশ্যমান কলাটিকে বোঝায়। তবে এতে সাধারণ বস্ত্রের মত টানা সুতাগুলি দৃশ্যমান হয় না, কেবল পোড়েন সুতাগুলি দৃশ্যমান হয়। বিভিন্ন রঙের পোড়েন সুতার ফোঁড়গুলিকে বিন্যাস বা নকশায় বিন্যস্ত করে শিল্পকর্মটি সৃষ্টি করা হয়। বুটিদার পর্দাগুলি বেশ ভঙ্গুর ও বানানো শ্রমসাধ্য; তাই ঐতিহাসিকভাবে এগুলিকে উল্লম্বভাবে দেয়ালে টাঙানোর জন্য বা কোনও আসবাবের উপরে ছড়িয়ে রাখার জন্য বানানো হত। পশম বা সুতির সুতা ছাড়াও রেশম, স্বর্ণ, রূপা বা অন্য ধরনের সুতার কাজও থাকতে পারে। তাপিশ্রী একটি সুপ্রাচীন বস্ত্রকলা। মিশরীয় ও ইনকা সভ্যতার লোকেরা তাদের সমাধির উপরে তাপিশ্রী বিছিয়ে দিত। গ্রিক ও রোমানরা পৌর ভবন ও মন্দিরগুলির দেয়ালের আবরণী হিসেবে এগুলি ব্যবহার করত। চীনারা পোশাক হিসেবে বা উপহার মোড়াতে এগুলি ব্যবহার করত। ইউরোপে মধ্যযুগে ফরাসি ও ফ্লেমীয় (ওলন্দাজ) তাঁতশিল্পীরা তাপিশ্রীর বিকাশ সাধন করেন। তাদের শিল্পকর্মে মূলত খ্রিস্টান ধর্মের পুস্তক বাইবেলের বিভিন্ন কাহিনী বিধৃত হয়েছিল। প্যারিস ছিল এ সময় পশ্চিমা তাপিশ্রীকলার কেন্দ্রবিন্দু। ১৭শ শতকে প্যারিস শহরে গোবলাঁ পরিবারের অধীনে একটি রাজকীয় তাপশ্রীঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেখানে ১০০০-এরও বেশি শিল্পী ২ হাজারেরও বেশি তাপিশ্রীকর্ম ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুইয়ের ভের্সাই প্রাসাদে ব্যবহারের জন্য সৃষ্টি করেন। ২০শ শতকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এসে আবারও ফ্রান্সে শিল্পটির পুনরুজ্জীবন ঘটে। ১৯৬২ সালে সুইজারল্যান্ডের লোজান শহরে প্রথম আন্তর্জাতিক তাপিশ্রী উৎসবের আয়োজন করা হয়, যেটি ১৯৬৫ সাল থেকে একটি দ্বিবার্ষিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। ২০শ শতকের শেষে এসে বিশ্বব্যাপী তাপিশ্রীর নকশা, উপাদান ও কৌশলে ব্যাপক বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়, যাদের মধ্যে পরিগণক যন্ত্র তথা কম্পিউটার-চালিত তাঁতের ব্যবহার উল্লেখ্য। বর্তমানে সারা বিশ্বে মাত্র হাজার খানেক তাপিশ্রী শিল্পী আছেন।

নকশিকাঁথা

কাছে থেকে দেখা রাজশাহীর কাঁথা। বাম ও নিচের দিক জুড়ে কাঁথার পাড় দেখা যাচ্ছে। কাঁথার জমিনে সাধারণ কাঁথা ফোঁড়ে সাদা সুতা দিয়ে তরঙ্গ আকারে সেলাই দেয়া হয়েছে।

“নকশি কাঁথা” হলো সাধারণ কাঁথার উপর নানা ধরনের নকশা করে বানানো বিশেষ প্রকারের কাঁথা। নকশি কাঁথা শত শত বছরের পুরনো ভারতের পশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশের লোকশিল্পের একটা অংশ। সাধারণত পুরাতন কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা তাঁতিদের থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সুতা কিনে এনে কাপড় সেলাই করা হয়। ঘরের মেঝেতে পা ফেলে পায়ের আঙ্গুলের সঙ্গে কাপড়ের পাড় আটকিয়ে সূতা খোলা হয়। এই সূতা পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য রেখে দেয়া হয়। সাধারণ কাঁথা সেলাইয়ের পর এর উপর মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুঁটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন নঁকশা যার মধ্যে থাকে ফুল, লতা, পাতা ইত্যাদি। সাধারণ কাঁথা কয়েক পাল্লা কাপড় কাঁথাফোঁড়ে সেলাই করা হলেও এই ফোঁড় দেয়ার নৈপুণ্যের গুণে এতেই বিচিত্র বর্ণের নকশা, বর্ণিল তরঙ্গ ও বয়নভঙ্গির প্রকাশ ঘটে। নকশার সাথে মানানোর জন্য বা নতুন নকশার জন্য কাঁথার ফোঁড় ছোট বা বড় করা হয় অর্থাৎ ফোঁড়ের দৈর্ঘ্য ছোট-বড় করে বৈচিত্র্য আনা হয়। উনিশ শতকের কিছু কাঁথায় কাঁথাফোঁড়ের উদ্ভাবনী প্রয়োগকে কুশলতার সাথে ব্যবহার করার ফলে উজ্জ্বল চিত্রযুক্ত নকশা দেখা যায়। কাঁথাফোঁড়ের বৈচিত্র্য আছে এবং সেই অনুযায়ী এর দুটি নাম আছেঃ পাটি বা চাটাই ফোঁড় এবং কাইত্যা ফোঁড়।

সূচিশিল্প

বাটিকশিল্প

গালিচা ও মাদুর বয়ন

তিউনিসিয়ার শিল্পীরা গালিচা বয়ন করছে।
শীতল পাটি
মূর্তা বেত দিয়ে শীতল পাটি বোনার দৃশ্য

শীতল পাটি এক ধরনের মেঝেতে পাতা আসন। এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যগত কুটির শিল্প। মুর্তা বা পাটি বেত বা মোস্তাক (বৈজ্ঞানিক নাম: Schumannianthus dichotomus) নামক গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছাল থেকে এগুলো তৈরি হয়ে থাকে। এই পাটি শীতল, মসৃণ ও আরামদায়ক বলে সমাদৃত। মুর্তা গাছ দেখতে সরু বাঁশের মতো; জন্মে ঝোপ আকারে। গোড়া থেকে কেটে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় মুর্তার কাণ্ড। দা দিয়ে চেঁছে পাতা ও ডাল-পালা ফেলে দেয়া হয়, দূর করা হয় ময়লা। এরপর মাটিতে মাছকাটার বটি ফেলে মুর্তার কাণ্ডটিকে চিড়ে লম্বালম্বি কমপক্ষে চারটি ফালি বের করা হয়। কাণ্ডের ভেতর ভাগে সাদা নরম অংশকে বলে ‘বুকা’। এই বুকা চেঁছে ফেলে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি পাটি তৈরী ক’রে তাকে বলা হয় ‘পাটিকর’ বা ‘পাটিয়াল’। পাটিকরের লক্ষ্য থাকে মুর্তার ছাল থেকে যতটা সম্ভব সরু ও পাতলা ‘বেতী’ তৈরী করে নেয়া। বেতী যত সরু ও পাতলা হবে পাটি তত নরম ও মসৃণ হবে। এজন্য হাতের নখ দিয়ে ছিলে বুননযোগ্য বেতী আলাদা করা হয়ে থাকে। বেতী তৈরী হওয়ার পর এক-একটি গুচ্ছ বিড়ার আকারে বাঁধা হয়। তারপর সেই বিড়া ঢেকচিতে পানির সঙ্গে ভাতের মাড় এবং আমড়া, জারুল ও গেওলা ইত্যাদি গাছের পাতা মিশিয়ে সিদ্ধ করা হয়। এর ফলে বেতী হয় মোলায়েম, মসৃণ ও চকচকে। রঙ্গীন নকশাদার পাটি তৈরীর জন্য সিদ্ধ করার সময় ভাতের মাড় ইত্যাদির সঙ্গে রঙের গুঁড়া মেশানো হয়। দক্ষ কারিগর একটি মুর্তা থেকে ১২টি পর্যন্ত সরু বেতি তৈরী করতে সক্ষম। ছিলে ছিলে বেতী তৈরীর সময় পাটিকর বুড়ো আঙ্গুল ও মধ্যমায় কাপড় পঁচিয়ে নেয় যাতে বেতীর ধারে আঙ্গুল না ফেঁড়ে যায়। পাটিকর মাটিতে বসে কাপড় বোনার মতই দৈর্ঘ্য-বরাবর এবং প্রস্থ-বরাবর বেতী স্থাপন ক’রে নেয়। পাটি বোনার সময় বেতীগুলোকে ঘন আঁট-সাঁট ক’রে বসানো হয় যাতে ফাঁক-ফোকড় না-থাকে। নকশী পাটির ক্ষেত্রে পাটিকর তার স্মৃতি থেকে বাদামী বা প্রাকৃতিক রঙের বেতীর সঙ্গে রঙ্গীন বেতী মিশিয়ে নকশা তৈরী করে।

ঝুড়ি বয়ন

বিভিন্ন বুননের তিনটি ঝুঁড়ি ও একটি বারকোশ

ঝুড়ি বয়ন বা ঝুড়িশিল্প বলতে শুকানো নমনীয় উদ্ভিজ্জ তন্তু যেমন দূর্বা, শর, ছোট কচি ডাল, বাঁশ, বেত, ইত্যাদির তন্তুকে জালের মতো পরস্পর-বিজড়িত করে বয়ন করে ধারণপাত্র (যাকে ঝুড়ি বলে) এবং অন্যান্য সদৃশ বস্তু প্রস্তুত করার ব্যবহারিক ও শৈল্পিক কর্মকাণ্ডটিকে বোঝায়। ঝুড়ির উপাদান হিসেবে কখনও কখনও কৃত্রিম তন্তুও ব্যবহৃত হতে পারে। ঝুড়ি বয়ন একাধারে শোভাবর্ধক ও ব্যবহারিক শিল্পকলা। কোনও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে কী ধরনের ঝুড়িশিল্পজাত দ্রব্য পাওয়া যাবে, তা ঐ অঞ্চলে সহজে লভ্য উদ্ভিদের প্রকৃতির উপরে নির্ভর করে। উপাদান তন্তুর দৃঢ়তা, রঙ, তন্তু বয়নের পদ্ধতি, যেমন কুণ্ডলিত অথবা বিনুনিকৃত বয়ন পদ্ধতি, ইত্যাদির উপর নির্ভর করে ঝুড়ির পৃষ্ঠতলে বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিনির্ভর শৈল্পিক নকশা করা যায়। এশিয়া, আফ্রিকা, ওশেনিয়ার বহু সংস্কৃতি ও আমেরিকা মহাদেশগুলির আদিবাসী সংস্কৃতিগুলিতে উৎকৃষ্ট মানের ঝুড়ি বয়ন শিল্প বিদ্যমান। এই সব সংস্কৃতিতে বহু প্রাচীনকাল থেকেই মাল পরিবহন, শুষ্ক খাবার সংরক্ষণ ও পরিবেশন ছাড়াও আরও বহু ব্যবহারিক কাজে ঝুড়ি বয়ন শিল্পজাত দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয়। ঝুড়ি বয়নের ইতিহাস সম্ভবত বস্ত্রবয়ন শিল্প ও মৃৎশিল্পের চেয়েও প্রাচীন। ইরাকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে বানানো ঝুড়ি পাওয়া গেছে।

কাদামাটি

মৃৎশিল্প

দুইটি ডালিম দিয়ে কারুকাজ করা থালা, পারস্য, ১৫শ শতক

মৃৎশিল্প হল এক ধরনের শোভাবর্ধক কলা যাতে বিশেষ ধরনের কাদামাটিকে (কুমারের মাটি) বিভিন্ন ধরনের শৈল্পিক আকৃতি দান করে ও পরে ভাঁটি বা চুল্লীতে অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রার পুড়িয়ে ভঙ্গুর কিন্তু শক্ত, অনমনীয়, রন্ধ্রহীন ও পানিনিরোধী একটি রূপে রূপান্তরিত করে নির্মাণ করা হয়। শৈল্পিক অভিব্যক্তির পাশাপাশি এই বস্তুগুলি দৈনন্দিন কাজেও ব্যবহৃত হয়, যেমন তরল পদার্থ ধারণের পাত্র কিংবা খাবার পরিবেশনের থালাবাসন বা বাটি, ইত্যাদি তৈজসপত্র। সাধারণত পোড়ানোর আগে মৃৎশিল্পকর্মের উপরে একটি স্বচ্ছ পাতলা প্রলেপ (glaze) প্রয়োগ করা হয়, যা শুকিয়ে চকচকে জলরোধী কাচের একটি প্রলেপ সৃষ্টি করে। মৃৎশিল্পকর্মগুলি তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এগুলি হল পোড়ামাটির বা মৃণ্ময় তৈজসপত্র (Earthenware), চীনামাটির তৈজসপত্র (Porcelain বা China) এবং পাথরের তৈজসপত্র (Stoneware)।

মাটির পুতুল
প্রতিমা নির্মাণ
ডোকরা

ডোকরা শিল্প পদ্ধতি একটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ, সূক্ষ্ম শিল্প কর্ম। প্রথমে শিল্পীরা পুকুর থেকে লাল বা সাদা মাটি সংগ্রহ করে ও মাটির মণ্ড তৈরি করে; এর পর মাটি দিয়ে হাতে করে একটি অবয়ব তৈরি করে। অবয়বটির উপর মোম ও তেলের প্রলেপ দেওয়া হয় । শেষে নরম মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। এর পর এটিকে পোড়ানো হয়। ফলে মোম গলে একটি ছিদ্র দিয়ে বাইড়ে বেরিয়ে আসে। এরপর ওই ছিদ্র দিয়ে গলানো পিতল ঢালা হয় এবং শক্ত হলে মূর্তিটি সংগ্রহ করা হয়। মূর্তিটি এর পর শিরিষ কাগজ দ্বারা ঘষে ঘষে উজ্জ্বল করা হয়।

কাঠ

দারুশিল্প

দারুশিল্প বলতে কাঠের তৈরী সামগ্রী এবং তদুপরি অঙ্কিত নকশা বোঝায়।

আসবাব

গৃহস্থালী সামগ্রী

অস্ত্র-শস্ত্র

যানবাহন

নৌশিল্প
পালকি

বাদ্যযন্ত্র

দারুভাস্কর্য

বিবিধ কাষ্ঠজাত সামগ্রী

ধাতু

জহুরির কাজ

মূল্যবান ধাতুকর্ম

১৫শ শতকের শেষভাগে ইসলামী শৈলীতে ইরানে নির্মিত সোণা দিয়ে গিলটি করা ও রূপা দ্বারা খচিত ব্রোঞ্জের জলপাত্র

স্বর্ণকর্ম

কাচ

কাচ শিল্পকলা বলতে সেসব একক শিল্পকর্মকে বোঝায় যেগুলি প্রধানত বা সম্পূর্ণরূপে কাচ দিয়ে তৈরি। স্মারকস্তম্ভ ও সংস্থাপিত শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে দেয়ালে বা ছাদে ঝুলন্ত শিল্পকর্ম, জানালা, এমনকি কর্মশালা বা কারখানায় নির্মিত শিল্পকর্ম যেমন কাচের গহনা ও তৈজসপত্র পর্যন্ত কাচ শিল্পকলার বিস্তার। প্রাচীন ফিনিসীয়, মিশর, আসিরিয়া ও রোমান সভ্যতাগুলিতে কাচের শিল্পকলার বিকাশ ঘটে। মধ্যযুগে ইউরোপের নর্মান ও গোথিক মহাগির্জার নির্মাতারা রঞ্জিত কাচের জানালাকে স্থাপত্য ও শোভাবর্ধনের একটি প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে এই শিল্পকলাটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। ইতালির ভেনিৎসিয়া অঞ্চলের মুরানো শহরে উৎপাদিত কাচ (ভেনিসীয় কাচ) বহু শতকের উদ্ভাবন ও পরিমার্জনের ফসল। মুরানোকে তাই আজও আধুনিক কাচ শিল্পকলার জন্মস্থান হিসেবে গণ্য করা হয়।

কাচের তৈজসপত্র

রঞ্জিত কাচ

শোলা শিল্প

অন্যান্য

চিত্রোপল শিল্প (মোজাইক শিল্প)

ব্যবহারিক কলা

স্থাপত্য

"নৃত্যরত বাসা", প্রাগ, চেক প্রজাতন্ত্র

স্থাপত্যকলা বলতে ভবন নকশা করার শিল্পকলা ও কারিগরি দক্ষতাকে বোঝায়। এটি ভবন নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট দক্ষতাগুলি থেকে স্বতন্ত্র। যারা স্থাপত্যকলা চর্চা করেন, তাদেরকে স্থপতি বলে। স্থপতিরা ভবনের বিভিন্ন গাঠনিক উপাদানের আকার, আকৃতি, রঙ, নির্মাণ সামগ্রী, শৈলী, উচ্চতা, শূন্যস্থান, আলো-ছায়ার খেলা, ইত্যাদির মাধ্যমে এক ধরনের শৈল্পিক দর্শন প্রকাশ করেন।

কিন্তু স্থপতিরা চিত্রকর বা ভাস্করদের মতো কেবল শিল্পের খাতিরেই ভবন নকশা করেন না। তাদেরকে অবশ্যই কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে একটি ভবন নকশা করতে হয়। একজন স্থপতি শুধু শিল্পকর্মই সৃষ্টি করেন না, তার কাজকে অবশ্যই ব্যবহারিক হতে হয়। ভবনটিকে কে কীভাবে ব্যবহার করবে, তা গণনায় রাখতে হয়। ভবিষ্যৎ ব্যবহারকারীর জ্ঞাত ও অজ্ঞাত চাহিদা, মূল্যবোধ ও চিন্তাধারার কথা মাথায় রেখে নকশাতে একেকটি ব্যবহারিক স্থানকে সঠিক আকার ও অনুপাতে বসাতে হয়। বাসভবন, রাজপ্রাসাদ, হাসপাতাল, জাদুঘর, বিমানবন্দর, ক্রীড়াক্ষেত্র - এগুলির প্রতিটির ব্যবহারিক প্রয়োজন ভিন্ন। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ের নকশা আর সেটির আঞ্চলিক ক্ষুদ্র শাখার কার্যালয়ের নকশা একই হয় না।

তাই স্থাপত্যকলাতে ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ও শৈল্পিক অভিব্যক্তি উভয়কেই গুরুত্ব প্রদান করা হয়; অর্থাৎ স্থাপত্যকলা একই সাথে উপযোগবাদী ও নান্দনিক। দুইটির একটিকেও বাদ দিলে তাকে স্থাপত্যকলা বলা চলে না। শুধুমাত্র উপযোগিতার কথা চিন্তা করে কোনও ভবন নির্মাণ করলে তা স্থাপত্যকলার কোনও নিদর্শন নয়। আবার কেবলমাত্র নান্দনিকতার কথা চিন্তা করে ভবন নির্মাণ করলে তা এক ধরনের ভাস্কর্য-সদৃশ চারুকলাতে পরিণত হয়। স্থাপত্যকলার ব্যবহারিক ও শৈল্পিক দিক দুইটির কোনটিকে কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হবে, তার কোনও সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। ভবনের সামাজিক বৃত্তি বা ব্যবহারের উপর নির্ভর করে এই দুইয়ের অনুপাতে হেরফের হতে পারে। যদি একটি কারখানা নকশা করতে হয়, তাহলে সেখানে দর্শক বা ব্যবহারিকারীদের সাথে শৈল্পিক যোগাযোগের গুরুত্ব কম। আবার যদি কোনও স্মৃতিসৌধ নকশা করতে হয়, তবে সেখানে উপযোগিতা গৌণ। আবার ধর্মীয় উপাসনালয় বা নগরভবনের মতো স্থাপনাগুলিতে উপযোগিতা ও শৈল্পিক যোগাযোগ উভয়েরই সমান গুরুত্ব থাকে।

ব্যবহারোপযোগিতা ও নান্দনিকতার পাশাপাশি ভবন বা স্থাপনার দীর্ঘস্থায়িত্বের ব্যাপারটিও স্থপতিকে মাথায় রাখতে হয়। বাস্তব বিশ্বে পরিবেশগত ও জলবায়ুগত ঝুঁকি ও ব্যবহারকারীদের সম্ভাব্য অপব্যবহারের কথা মাথায় রেখে স্থাপনা বা ভবনের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করার ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হয়। ঠিকমত নকশা না করা হয়ে দেয়াল ও ছাদ বেঁকে, ফেটে বা ধ্বসে যেতে পারে। বহু শতাব্দীর ধরে ভবন নির্মাণের পুঞ্জীভুত অভিজ্ঞতা স্থপতিদেরকে এই সব নির্মাণগত ঝুঁকি এড়িয়ে নকশা বানাতে সাহায্য করে। আবার সময়ের সাথে নতুন নতুন দীর্ঘস্থায়ী, ঘাতসহ ও আরও অনেক অভূতপূর্ব ধর্ম প্রদর্শনকারী নির্মাণ প্রযুক্তি ও উপাদানের উদ্ভাবন স্থপতিদের সৃষ্টিশীল নতুন সব নকশা নির্মাণের সুযোগ করে দেয়।

প্রতিটি মানবসমাজ তার চারপাশের প্রকৃতির সাথে এক ধরনের স্থানিক সম্পর্ক বজায় রাখে। পরিবেশ, জলবায়ু, আবহাওয়া, ইতিহাস, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শৈল্পিক সংবেদনশীলতা, দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ—এ সব কিছুই ঐ সমাজের ভবন ও অন্যান্য নির্মাণকাজগুলির স্থাপত্যে প্রতিফলিত হয়। চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্য বিশ্বের সর্বত্র সৃষ্টি করা সম্ভব; কিন্তু স্থাপত্যকলা কোনও নির্দিষ্ট স্থানের ভূগোল, জলবায়ু ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। স্থপতিরা স্থানীয় নির্মাণ উপাদান ও ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় মূলসুর বা মোটিফের উপরে নজর রাখেন। এছাড়া স্থপতিকে ভবন নির্মাণের খরচের কথাও মাথায় রাখতে হয়। অর্থাৎ স্থাপত্যকলায় ব্যবহারিক চাহিদা, সমাজ ও সংস্কৃতি, পরিবেশ, জলবায়ু, অর্থনীতি, শিল্পকলা ইত্যাদি সব কিছুর মেলবন্ধন ঘটাতে হয়।

শিল্পজাত পণ্য নকশাকরণ

শিল্পজাত পণ্য নকশাবিদরা কাগজে আঁকা নকশা ও ত্রিমাত্রিক প্রতিমা বা প্রোটোটাইপ নিয়ে কাজ করছেন।

শিল্পজাত পণ্য নকশাকরণ বা সংক্ষেপে পণ্য নকশাকরণ বলতে শিল্পকারখানায় গণহারে উৎপাদিত ভোগপণ্যের নকশা প্রণয়ন করাকে বোঝায়। শিল্পজাত পণ্য নকশাবিদেরা সাধারণত স্থাপত্যকলা বা অন্যান্য পেশাদারী দৃশ্যকলার প্রশিক্ষণ লাভ করেন, তবে বর্তমানে এটিকে আলাদা একটি শাস্ত্র হিসেবেও বিভিন্ন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানো শুরু হয়েছে। শিল্পজাত পণ্য নকশাবিদের মূল দায়িত্ব হল এমন সব শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করতে সহায়তা করা, যে পণ্যগুলি মূল ব্যবহারিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন করা ছাড়াও দেখতে সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়, সহজে ব্যবহারোপযোগী হয় এবং একই রকমের অন্যান্য পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এগিয়ে থাকে। অর্থাৎ শিল্পজাত পণ্য নকশাকরণে ব্যবহারিক উদ্দেশ্য, বাইরের রূপ, এবং ব্যবহারকারী ও উৎপাদনকারী উভয়ের কাছে পণ্যটির অর্থনৈতিক মূল্য—এই তিনটি ব্যাপারকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া ২১শ শতকে এসে পরিবেশ-বান্ধব নকশা প্রণয়নও অধিকতর গুরুত্ব লাভ করেছে। একজন শিল্পজাত পণ্য নকশাবিদের কাজের সাথে বিজ্ঞাপন ও মোড়কীকরণের জন্য চিত্রলৈখিক নকশা প্রণয়ন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য আকর্ষণীয় ভাবমূর্তি ও মার্কা নির্মাণ এবং গৃহাভ্যন্তর নকশাকরণের মতো ক্ষেত্রগুলির সম্পর্ক আছে। একজন শিল্পজাত পণ্য নকশাবিদ একটিমাত্র বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অধীনে সেই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাজারজাতকৃত বিভিন্ন পণ্যের উপরে কাজ করতে পারেন। অথবা তিনি একজন উপদেষ্টা নকশাবিদ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রকল্পে কাজ করতে পারেন।

প্রাচীনকালে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ বা সরঞ্জাম মূলত মানুষ নিজেই বানাতো বা স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে বানিয়ে নিতো। মধ্যযুগের শেষে এসে বাণিজ্যের বিকাশ ও শ্রম বিভাজনের সাথে সাথে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে এবং বড় বড় নগরীগুলিতে বিশেষায়িত কারিগরদের বড় বড় কর্মশালার উদ্ভব ঘটে। ১৮শ শতকের শেষে বাষ্পীয় ইঞ্জিনভিত্তিক শিল্প বিপ্লব ঘটার পর কর্মশালাগুলি মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি ক্ষমতার যন্ত্রভিত্তিক কারখানায় পরিণত হয়। প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত সিংহভাগ ভোগপণ্যই (সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি, উপকরণ) বিভিন্ন শিল্পকারাখানায় গণ-উৎপাদিত হতে শুরু করে। এরই সূত্র ধরে মূলত ২০শ শতকে এসে শিল্পজাত পণ্য নকশাকরণ ক্ষেত্রটির জন্ম ও বিকাশ ঘটে। কেউ কেউ জার্মান স্থপতি পেটার বেরেন্‌স-কে ইতিহাসের সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য শিল্পজাত পণ্য নকশাবিদ হিসেবে গণ্য করেন। পাশ্চাত্যে জার্মান নকশাবিদেরা (যেমন ভাল্টার গ্রোটিয়াস) অগ্রপথিক হলেও ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশক থেকে মার্কিন নকশাবিদেরা শিল্পজাত পণ্য নকশাকরণ ক্ষেত্রটিতে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন। মার্কিন নকশাবিদরা তাদের কাজে পরিষ্কার সরলরেখা ও দক্ষতাবর্ধক প্রবাহরেখার (streamline) ব্যবহারকে গুরুত্ব প্রদান করেন। ১৯৮০-র দশকে এসে শিল্পজাত পণ্য নকশাকরণ একটি স্বতন্ত্র পেশায় পরিণত হয় এবং নকশাবিদদের বাণিজ্যিক সংস্থা বা এজেন্সি সৃষ্টি হতে থাকে।

একজন শিল্পজাত পণ্য নকশাবিদ দৈনন্দিন জীবনের কোনও ব্যবহারিক চাহিদা পূরণ করতে বা কোনও সমস্যার সমাধান করতে কিংবা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে অনেকগুলি বিষয় মাথায় রেখে একটি নতুন বা পরিশীলিত গণ-উৎপাদনযোগ্য পণ্যের নকশা বা পরিকল্পনা করেন। এই কাজ করার সময় তিনি পণ্যটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য, এটির শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়া, এটির ভবিষ্যৎ ব্যবহারকারীর আচরণ, কর্মদক্ষতা, আকার, রঙ, বুনট, উপাদান-পদার্থ, চূড়ান্ত পালিশ, ইত্যাদির পাশাপাশি উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মার্কার মূল্য বৃদ্ধি, পণ্যটির উপকারিতার বৃহত্তর সমাজকে অবহিত করার মতো ব্যাপারগুলি গণনায় রাখেন। তিনি নকশা, আদি প্রতিমা ও নকশাকরণ প্রক্রিয়ার লিখিত বিবরণের মাধ্যমে পরিষ্কার ও সংক্ষিপ্ত রূপে তার সমাধান উপস্থাপন করেন। তিনি প্রথমে কাগজের উপরে নকশা আঁকেন, এরপর সেগুলিকে কম্পিউটারে স্থানান্তর করে ত্রিমাত্রিক বস্তু হিসেবে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সম্পাদনা করেন। একজন শিল্পজাত পণ্য নকশাবিদ এককভাবে কাজ করেন না, বরং তারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বিপণন বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ (তড়িৎ ও ইলেকট্রনীয় প্রকৌশলী, যন্ত্রপ্রকৌশলী ও শিল্প প্রকৌশলী) এমনকি মনোবিজ্ঞানী ও মানব-আচরণ বিজ্ঞানীদের সাথে একত্রে মিলে একটি বৃহত্তর সৃষ্টিশীল দলের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তিনি হাতে-কলমে, উপকরণের সাহায্যে কিংবা ত্রিমাত্রিক মুদ্রণের সাহায্যে বহুসংখ্যক আদি প্রতিমা (Prototype) তৈরি করেন। শিল্পজাত পণ্যের নকশাবিদেরা পণ্যের নকশার সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে গবেষণা করে দেখেন, কেননা এই ভৌত পণ্যসামগ্রী বা যন্ত্রাংশসামগ্রী একবার উৎপাদিত হয়ে গেলে সফটওয়্যার বা এজাতীয় বিমূর্ত পণ্যের মতো হালনাগাদ করা সম্ভব নয়। শিল্পজাত পণ্যের নকশাবিদ যে সমাজের সদস্য, তাঁর নকশাতে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং তাঁর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার ছাপ পড়ে। আবার শিল্পজাত পণ্যের নকশাবিদদের বর্তমান প্রতিমান বা মডেলগুলি থেকে ভবিষ্যতের সমাজের দৈনন্দিক জীবনে কী ধরনের পণ্য ব্যবহৃত হবে, তার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। শিল্পজাত পণ্য নকশাবিদ তাই ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ও দক্ষতা, নান্দনিক শিল্পকলা ও অর্থনৈতিক মূল্য উৎপাদনের মধ্যে মেলবন্ধনই কেবল স্থাপন করেন না, বরং তার কাজ বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে চারপাশের পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে আন্তঃক্রিয়া সম্পাদন করবে, সেটি নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বেশভূষাশৈলী নকশাকরণ

কলকাতাভিত্তিক বেশভূষাশৈলী নকশাবিদ সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের নকশাকৃত বেশভূষা পরে মঞ্চে প্রদর্শন করছেন মডেল নয়নিকা চট্টোপাধ্যায়

বেশভূষাশৈলী নকশাকরণ (ইংরেজিতে ফ্যাশন ডিজাইন) বলতে নান্দনিকতা, রুচি, স্বাভাবিক সৌন্দর্য ইত্যাদি ব্যাপারগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন রঙ, উপাদান, বিন্যাস বা সজ্জা ও শৈলীর সমন্বয়ে পোশাক ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক পরিধেয় দ্রব্যের নকশা করার ব্যবহারিক, শৈল্পিক ও পেশাদারী কর্মকাণ্ডটিকে বোঝানো হয়। স্থানভেদে ও কালভেদে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মনোভাব বেশভূষাশৈলী নকশাকরণ প্রক্রিয়ার উপরে প্রভাব ফেলে থাকে। যারা বেশভূষাশৈলী নকশা করেন, তাদেরকে বেশভূষাশৈলী নকশাকার বা বেশভূষাশৈলী নকশাবিদ (ইংরেজিতে ফ্যাশন ডিজাইনার) বলা হয়। বেশভূষাশৈলী নকশাবিদেরা ভোক্তাদের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে আগে থেকেই বেশভূষাশৈলীর চল আঁচ করার চেষ্টা করেন যাতে তাদের নকশাকৃত শৈলীর বেশভূষাগুলি ঠিক সময়ে বাজারে আনা যায়। এ জন্য তারা সমাজে প্রচলিত বেশভূষাশৈলীর চল বা ধারা নিয়ে গবেষণা করেন ও নতুন নকশার বেশভূষাশৈলী প্রদর্শন করেন। তাদের প্রদর্শিত কিছু নতুন নকশা আবার বেশভূষা নির্মাতা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলি গ্রহণ করে ও এগুলির গণ-উৎপাদন করে। এর ফলে সমাজে আবার নতুন শৈলী বা নকশার বেশভূষার চল শুরু হয়। এভাবে বেশভূষাশৈলীর নকশাকরণ, বেশভূষার উৎপাদন ও সমাজে বেশভূষাশৈলীর চলের চক্রটি চলতে থাকে। বেশভূষাশৈলী নকশাবিদেরা এককভাবে কাজ করতে পারেন কিংবা কোনও প্রতিষ্ঠানের অংশ হিসেবে কাজ করতে পারেন।

বেশভূষাশৈলী নকশাকরণে যে উপাদান ও মূলনীতিগুলি নিয়ে কাজ করা হয়, তাদের মধ্যে রয়েছে রঙ বা বর্ণ, আকৃতি, ঋণাত্মক আকৃতি (negative shape), রূপরেখা (Sihouette), গতি, বুনট (texture), প্রতিসাম্য (symmetry), অপ্রতিসাম্য (asymmetry), কারুকাজ, বিন্যাস, স্বচ্ছতা, আয়তন, রেখা, পক্ষপাত, খণ্ড (block), স্তর, বৈপরীত্য, পৃষ্ঠতল, মূলসুর (motif), রেখা, নির্মাণ, বিনির্মাণ, আবরণ বা আচ্ছাদন, ব্যবহারিক উদ্দেশ্য, ছাপ, দিক, গুচ্ছ, ইত্যাদি।

বেশভূষাশৈলী নকশাকরণের কাজটি সমাজের চাহিদার উপর নির্ভরশীল কোনও পরোক্ষ কর্মকাণ্ড নয়, বরং সমাজকে পরিবর্তনকারী এক ধরনের সক্রিয় কর্মকাণ্ড। বেশভূষাশৈলী নকশাবিদদের কিছু কাজের উপর ভিত্তি করে প্রতি বছর লক্ষ-কোটি বেশভূষা শিল্পোৎপাদন করা হয়, ফলে সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিদের বাহ্যিক অবয়ব বা সাজ কীরকম হবে, তার উপরে বেশভূষাশৈলী নকশাবিদদের অপরিসীম প্রভাব আছে। বেশভূষাশৈলী নকশাবিদেরা তাদের নকশাগুলিকে পরিচিত করানোর লক্ষ্যে নিয়মিত বেশভূষাশৈলী প্রদর্শনী-র আয়োজন করেন, নিজস্ব মার্কার বেশভূষার খুচরো দোকান পরিচালনা করেন। কিছু বেশভূষাশৈলী নকশাবিদ এতই জনপ্রিয় যে তাঁরা নিজেরা কোনও নকশা করেন না, বরং অন্যের করা নকশায় নিজের নাম ব্যবহার করার অনুমতি দেন।

অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণ

একটি রেস্তোরাঁর নকশাকৃত অভ্যন্তরভাগ

অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণ বলতে মানবনির্মিত কোনও আবাসিক বা অনাবাসিক ভবন, স্থাপনা বা কক্ষের অভ্যন্তরভাগকে অধিকতর ব্যবহার-বান্ধব, স্বাস্থ্যকর এবং নান্দনিকভাবে প্রীতিকর করা বোঝায়। এটি কোনও ভবন বা কক্ষের অভ্যন্তরভাগের বিভিন্ন ব্যবহারিক ও শোভাবর্ধক উপাদানগুলির নকশাকরণ, এগুলির মধ্যে সমন্বয়-সাধন ও একটি সুষম পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে এগুলিকে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানের কলা ও পেশা। অভ্যন্তরভাগের উপাদানগুলির মধ্যে আছে ছাদ, মেঝে, দেয়াল, দরজা, জানালা, আসবাবপত্র, মাদুর-গালিচা, (দেয়াল, মেঝে বা ছাদে) সংযুক্ত সরঞ্জামাদি, আলোর উৎস, কাপড়, কারু-দারু-মৃণ্ময় শিল্পবস্তু, প্রাকৃতিক উপাদান (যেমন ছোট গাছ বা ফুল), অভ্যন্তরভাগের স্থাপত্য, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে। অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণের উদ্দেশ্য হল কোনও ভবনের অভ্যন্তরভাগে জীবনযাপনকারী ব্যক্তিরা কীভাবে সেই স্থানটি দেখবে ও অনুভব করবে, সেই স্থানটি তাদের ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত শৈলীর প্রতিফলন হবে কি না, সেই ব্যাপারগুলির উন্নতি সাধন করে ঐ ব্যক্তিদের জীবনের মানোন্নয়ন করা। অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণে কাঠামোগত নকশা (যেমন স্থানিক বিন্যাস, উপাদান, ও সংযুক্ত সরঞ্জামাদি) এবং শোভাবর্ধক নকশা (যেমন রঙ, আসবাবপত্রের নির্বাচন ও বিন্যাস, শোভাবর্ধক ঝোঁক) --- এই দুইটি দিকই বিদ্যমান। মানুষ যে পরিবেশে বাস করে, তা তার মেজাজ ও আবেগের উপরে সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণ অভ্যন্তরভাগ ব্যবহারকারীদের বা বাসকারীদের উপরে সরাসরি প্রভাব ফেলে। অভ্যন্তরভাগ মানুষকে শান্ত, বদমেজাজী, উৎফুল্ল বা বিমর্ষ করে তুলতে পারে। একটি সুন্দরভাবে নকশাকৃত অভ্যন্তরভাগ জীবনকে সুস্থ ও সুখী করে তুলতে পারে। অধিকন্তু, অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণের ফলে ভবিষ্যত ক্রেতার কাছে কোনও ভবনের আকর্ষণীয়তা ও আর্থিক মূল্যমান বৃদ্ধি পেতে পারে।

অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণের কলাটি স্থাপত্যকলার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ইউরোপের কোনও কোনও দেশে এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত পেশা এবং সেখানে এটি গৃহাভ্যন্তর স্থাপত্য হিসেবে পরিচিত। মানবনির্মিত পরিবেশকে আকৃতি প্রদানকারী বিভিন্ন উপাদান নিয়ে যে শাস্ত্রটি জড়িত, সেই বৃহত্তর শাস্ত্রটিকে পরিবেশ নকশাকরণ বলে; গৃহাভ্যন্তর নকশাকরণকে পরিবেশ নকশাকরণের একটি অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। যিনি অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণ প্রকল্পের পরিকল্পনা, গবেষণা, সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাকে অভ্যন্তরভাগ নকশাবিদ বলা হয়। অভ্যন্তরভাগের শোভাবর্ধন ও অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটি কোনও পেশা নয়, কিন্তু দ্বিতীয়টি একটি পেশা; পেশাদার অভ্যন্তরভাগ নকশাবিদরা বিশেষায়িত ও আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ অর্জন করেন।

অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণে কোনও ভবনের অভ্যন্তরভাগ ব্যবহারকারী মানুষদের বিভিন্ন ধরনের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হয়। এতে সৃষ্টিশীলতা, কারিগরি দক্ষতা, দীর্ঘস্থায়িত্ব ও ব্যবহারিকতা, ইত্যাদির মেলবন্ধন ঘটানো হয়। একদিকে ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখা হয়। অন্যদিকে শৈলী ও নান্দনিকতার মতো বিষয়গুলির উপরে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কখনও কখনও বিশেষ দর্শনেরও প্রয়োগ করা হতে পারে। রঙ, বুনট, আলোকসম্পাত, মাপ ও অনুপাতের দিকে নজর রাখা হয়। আসবাব ও সরঞ্জামগুলি যেন ব্যবহারকারীদের চাহিদা ও জীবনচর্যার সাথে খাপ খায় এবং নির্দিষ্ট স্থানের সাথে সঠিক অনুপাতে বসে, তার দিকে খেয়াল রাখা হয়। অভ্যন্তরভাগ একটি বহুমুখী পেশা যাতে ধারণা সৃষ্টি, স্থান পরিকল্পনা (স্থানের চাহিদা বিশ্লেষণ, স্থানের বণ্টন, ব্যবহারকারীদের কাজের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক), নির্মাণস্থল পর্যবেক্ষণ, কর্মসূচি তৈরিকরণ, গবেষণা, প্রকল্পের অংশীজনদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন, নির্মাণকর্ম ব্যবস্থাপনা, এবং নকশা বাস্তবায়নের মতো কাজগুলি অন্তর্ভুক্ত থাকে। কার্যালয়, হাসপাতাল, দোকান ও বিদ্যালয়ে নান্দনিক বিষয়গুলির চেয়ে ব্যবহারিক কাজকর্মের পরিস্কার সংগঠনের উপরে বেশি জোর দেওয়া হয়।

অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণ একটি স্বতন্ত্র কলা বা পেশা হিসেবে আধুনিক হলেও ভবন, গৃহ বা কক্ষের শোভাবর্ধনের কলাটি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। দেয়ালচিত্র, তাপিশ্রী (বুটিদার চিত্রিত পর্দা), গালিচা, মাদুর, মূর্তি, আসবাবপত্রসহ বহু বিচিত্র ধরনের বস্তু শোভাবর্ধন বা ব্যবহারিক কাজে ব্যবহার করা হত। ১৯শ শতকে পাশ্চাত্যে অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণের সবচেয়ে বিখ্যাত চর্চাকারীদের একজন ছিলেন লেখক, সমালোচক ও শিল্পী অস্কার ওয়াইল্ড। তিনি সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন ও দ্য হাউজ বিউটিফুল নামের একটি বক্তৃতামালা প্রদান করেন। ২০শ শতকে হাউজ বিউটিফুলদ্য লেডিজ হোম জার্নাল নামক সাময়িকীগুলি ইংরেজিভাষী বিশ্বে অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণের রীতিনীতিগুলির আকৃতি প্রদান করতে সহায়তা করে। দুই বিশ্বযুদ্ধ ও বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণের বিভিন্ন আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। অভ্যন্তরভাগ নকশাকরণের ইতিহাস ও কলা বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্র বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অধ্যয়ন করা হয়।

সাধারণত সমগ্র ভবনের জন্য একটি বিশেষ শৈলী পছন্দ করা হয়, যাতে শোভাবর্ধক উপাদানগুলির মধ্যে ঐক্য ও সঙ্গতির মূলনীতিগুলির প্রয়োগ ঘটে। আনুষ্ঠানিক, অগোছালো, ঐতিহ্যবাহী, সমকালীন, সারগ্রাহী, ইত্যাদি বিভিন্ন শৈলীর মধ্যে যেকোনও একটিকে পছন্দ করা হতে পারে এবং এরপর আরও বিশেষ কোনও উপশৈলী নির্বাচন করা হতে পারে। পাশ্চাত্যের কিছু জনপ্রিয় বিশিষ্ট শৈলীর মধ্যে আছে গ্রামীণ শৈলী, ন্যূনতমবাদী শৈলী, আধুনিক খামারবাড়ি শৈলী, মধ্য-শতকীয় আধুনিক শৈলী, ফরাসি গ্রামীণ শৈলী, শিল্পকারখানা শৈলী, ভূমধ্যসাগরীয় শৈলী, আর দেকো শৈলী, আধুনিক জাপানি শৈলী, উপকূলীয় শৈলী, মার্কিন সমুদ্রসৈকত শৈলী, উৎকৃষ্ট পুরাতন শৈলী এবং বৈশ্বিক শৈলী। ভবন বা কক্ষের দৃশ্যমান উপাদানগুলির ওজনগুলির মধ্যে ভারসাম্য ও প্রতিসাম্যের মতো মূলনীতিগুলি প্রয়োগ করা হতে পারে। ভারসাম্যের জন্য মাপ (বড় বা ছোট), বুনট (শক্ত বা নরম বস্তু), অবস্থান (উপরে, নিচে, ডানে, বামে বা চোখের সমতলে), ইত্যাদি ব্যাপারগুলি মাথায় রাখতে হয়। ভবনের যেকোনও কক্ষে একটি দৃষ্টি-আকর্ষী বিন্দু থাকতে হয়, যেটি মাপ, রঙ বা বুনট দ্বারা স্বতন্ত্র হয়ে থাকে। বৈসাদৃশ্য ও বৈচিত্র্যের মতো মূলনীতিগুলি ভবন বা কক্ষের উপাদানগুলিকে আরও আগ্রহজনক করে তোলে। একই রঙ, বুনট বা বিন্যাস বারংবার প্রয়োগের দ্বারা কিংবা আকার ও রঙের প্রগতি দ্বারা ছন্দ নামক মূলনীতি বাস্তবায়ন করা হতে পারে।

চিত্রলৈখিক নকশা প্রণয়ন

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিত্রলৈখিক নকশা প্রণয়নে কর্মরত নকশাপ্রণেতাগণ।

চিত্রলৈখিক নকশা প্রণয়ন (ইংরেজিতে গ্রাফিক ডিজাইন) বলতে এমন একটি পেশাদারী কলাকে বোঝায় যেখানে কোনও একটি পৃষ্ঠতলে মুদ্রাক্ষরসজ্জা, আলোকচিত্রকলা ও চিত্রাঙ্কনকলার দক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমে সাধারণত একাধিক সুনির্বাচিত প্রতীক, চিত্র ও পাঠ্যবস্তুর (অক্ষর, শব্দ, ইত্যাদি) পরিকল্পিত মিলন ঘটিয়ে একটি সুসজ্জিত সমাহার সৃষ্টি করে কোনও ধারণা বা বার্তাকে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ দান করা হয়, যার অন্তিম লক্ষ্য নকশাটিকে যান্ত্রিকভাবে পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে সাধারণত বহুসংখ্যক পাঠক-দর্শকের কাছে সেই বার্তাটিকে জ্ঞাপন করা (অর্থাৎ দৃষ্টিনির্ভর গণযোগাযোগ স্থাপন করা)। এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট নকশাটি কোনও ভৌত মাধ্যমে (physical) কিংবা অসদ্‌ মাধ্যমে (virtual) রূপায়িত হতে পারে, স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদের সময়ের জন্য পরিবেশিত হতে পারে, ক্ষুদ্র একক ডাকটিকিট থেকে শুরু করে জাতীয় ডাকসংকেত ব্যবস্থার মত বিশালায়তন হতে পারে। নকশার উদ্দীষ্ট দর্শকের সংখ্যা সীমিত হতে পারে, যেমন কোন এককালীন প্রদর্শনীর নকশা প্রণয়ন বা সীমিত-প্রকাশনার বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ; আবার এটি লক্ষ কোটি দর্শকের জন্যও তৈরি করা হতে পারে, যেমন কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থার ওয়েবসাইটের নকশা। কেবল বাণিজ্যিক নয়, শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও চিত্রলৈখিক নকশা প্রণয়ন করা হতে পারে। চিত্রলৈখিক নকশাপ্রণেতারা প্রাচীরপত্র, বিজ্ঞাপনী প্রচারপত্র, মুদ্রিত বিজ্ঞাপন, মোড়ক ও অন্যান্য মুদ্রিত মাধ্যমের জন্য এবং সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে তথ্য লেখচিত্রণের জন্য নকশা প্রণয়ন করেন।

কম্পিউটার চিত্রলিখন

আলোকিত পুঁথিরচনা

বাইবেলের মথির সুসমাচারের আলোকিত পুঁথির দুইটি পাতা; বামের পাতায় মথির প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছে। ৮ম শতকের মধ্যভাগে ইংল্যান্ডের ক্যান্টারবেরিতে লিখিত।
১৩শ শতকে বাগদাদে লিখিত কুরআনের আলোকিত পুঁথি

পাশ্চাত্যে আলোকিত পুঁথিরচনা বলতে মধ্যযুগে হাতে লেখা পুঁথির একটি বিশেষ কলাকে বোঝায় যাতে লিখিত বিষয়বস্তুগুলিতে বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙ, সোনা বা রূপার কারুকাজ, বিস্তীর্ণ নকশা ও ক্ষুদ্র চিত্র ব্যবহার করে সেগুলির শোভাবর্ধন করা হত। ইউরোপের পাশাপাশি বিভিন্ন ইসলামী সমাজেও এইরূপ পুঁথি লেখার চল ছিল; তবে ইউরোপে এই কলাটির ঐতিহ্য অনেক বেশী প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী। সাধারণত বাছুর, ভেড়া বা ছাগলের চামড়ার উপরে লেখা হত। এগুলি মূলত খ্রিস্টান মঠগুলিতে খ্রিস্টীয় ধর্মীয় রচনাবলি লিখতে ব্যবহৃত হত। ১৭শ শতকে মুদ্রণ শিল্পের আবির্ভাবের পরে ও ধর্ম-বহির্ভূত রচনা পাঠে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পেলে এই শিল্পের অবসান ঘটে।

চিত্রালঙ্করণ

কাকেশ্বর; বাংলা আবোল-তাবোল (ননসেন্স) লেখক সুকুমার রায়ের রচিত হযবরল-তে লেখকের নিজের আঁকা চিত্রালঙ্করণ

চিত্রালঙ্করণ বা চিত্রণ (ইংরেজি Illustration) বলতে কোনও পাঠ্য রচনার ভেতরে স্থাপিত রেখাচিত্র, রঙচিত্র বা আলোকচিত্রকে বোঝায় যা পাঠ্য বিষয়বস্তুকে ব্যাখ্যা করতে, এর অর্থ পরিস্কার করতে, সেটিকে চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে বা রচনাটির আলঙ্কারিক শোভাবর্ধন করতে ব্যবহৃত হয়। ঐতিহাসিকভাবে গ্রন্থ, সাময়িকী, সংবাদ পত্রিকা, ইত্যাদি মুদ্রিত বিষয়বস্তুতে চিত্রালঙ্করণ প্রযুক্ত হলেও চিত্রালঙ্করণ শিল্পীরা প্রাচীরচিত্র (পোস্টার), বিজ্ঞাপন, কমিক বই, কার্টুন, সচলচিত্র, শুভকামনাজ্ঞাপক পত্র, ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তাদের দক্ষতার প্রয়োগ করে থাকেন। বৈজ্ঞানিক পাঠ্যপুস্তকে, সাহিত্য বিশেষ করে শিশুতোষ গ্রন্থ ও রচনাতে, অলীক কাল্পনিক খেলা ও বইয়ে, সাময়িকী ও সংবাদপত্রে, এবং বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রাচীরপত্র ও পণ্যের মোড়কে চিত্রালঙ্করণ ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে কম্পিউটার বা টেলিভিশনের পর্দায় দৃশ্যমান ডিজিটাল বিষয়বস্তু যেমন চলচ্চিত্র, ভিডিও খেলা, ওয়েবসাইট, সচলচিত্র (অ্যানিমেশন), ইলেকট্রনীয় বই ও পত্রপত্রিকা, ইত্যাদিতেও চিত্রালঙ্করণ শিল্পীরা কাজ করে থাকেন।

প্রাথমিকভাবে কালি-কলম, কাঠকয়লা, ধাতুচঞ্চু, ইত্যাদি দিয়ে চিত্রালঙ্কারটি অঙ্কন করা হত ও তারপরে বিভিন্ন ধরনের মুদ্রণ প্রক্রিয়া যেমন খোদাই করা কাঠের ছাপচিত্র, খোদাইকৃত ধাতুর ছাপচিত্র, প্রস্তরচিত্রণ, আলোকচিত্রণ, ইত্যাদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এগুলিকে পুনরুৎপাদন করা হত। বর্তমানে ঐসব পদ্ধতির পাশাপাশি কম্পিউটারে চিত্রলিখন সফটওয়্যার যেমন অ্যাডোবি ইলাস্ট্রেটর, ফটোশপ, কোরেলড্র, ইত্যাদি প্রোগ্রাম ব্যবহার করে এবং আঁকার ট্যাবলেট ব্যবহার করে অঙ্কনকর্ম সম্পাদন করার ব্যাপক চল শুরু হয়েছে। চিত্রালঙ্করণ চারুকলা, ব্যবহারিক কলা নাকি শোভাবর্ধক কলা - এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ঐতিহাসিক চিত্রালঙ্করণশিল্পীদের সেরা শিল্পকর্মগুলিকে গণনায় ধরলে এটিকে রঙচিত্র অঙ্কন ও ভাস্কর্যের মতো চারুকলা হিসেবে গণ্য করা চলে।

সাহিত্যকলা

শিল্পকলার দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯শ শতকের পর থেকে গৃহীত এবং বর্তমানে সর্বজনবিদিত সংজ্ঞানুযায়ী সাহিত্য হল ইতিহাসের কোনও নির্দিষ্ট পর্বে ও নির্দিষ্ট কোনও ভৌগোলিক অঞ্চলে অবস্থিত কোনও ভাষার নান্দনিক বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবহার। আরও ব্যাপকভাবে বলতে গেলে সাহিত্য হল সামাজিক, দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে আগ্রহজনক কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুর উপরে লিখিত সেইসব সৃষ্টিশীল রচনাবলি, যেগুলির লিখনশৈলী ও অভিব্যক্তিকে কালোত্তীর্ণ উৎকৃষ্ট শৈল্পিক মানের অধিকারী হিসেবে গণ্য করা হয়। সাহিত্যকে গদ্য, পদ্য ও নাট্য—এই তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। গদ্যে দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক বাক্য সংগঠন ব্যবহার করা হয় এবং বাক্য, অনুচ্ছেদ, পরিচ্ছেদ, ইত্যাদি ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয়। পদ্যে ধ্বনি, ধ্বনিদল, শব্দ, পঙ্‌ক্তি, ছন্দ, মাত্রা, ইত্যাদির আলঙ্কারিক, নান্দনিক, বিমূর্ত, সৃষ্টিশীল ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর নাট্যে চরিত্রদের মধ্যে কথোপকথন ও দর্শকের সামনে বিভিন্ন ঘটনা প্রাণবন্ত অঙ্গভঙ্গি করে পরিবেশনের উপরে জোর দেওয়া হয়। গদ্যের বিভিন্ন রূপের মধ্যে আছে উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, জীবনী, আত্মজীবনী, রোজনামচা, স্মৃতিচারণমূলক রচনা, ঐতিহাসিক বিবরণ, ভ্রমণবৃত্তান্ত, সমালোচনা সাহিত্য, দার্শনিক রচনা, ইত্যাদি। পদ্যের মধ্যে আছে কবিতা, গীতিকবিতা, মহাকাব্য, শোকগাথা, চতুর্দশপদী, ছড়া, ইত্যাদি। নাট্যকে বিয়োগান্ত, হাস্যরসাত্মক, হাস্যকরুণরসাত্মক, আবেগ-উত্তেজনাপূর্ণ, ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা যায়।

কোন্ রচনা সাহিত্য আর কোন্‌টি নয়, সেটি বিচারের কোনও সার্বজনীন বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ড নেই, কোনও রচনার শিল্পমান বহুলাংশেই পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। তবে সাধারণত সাহিত্য কোনও দৈনন্দিন ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয় না; পাঠ্যপুস্তক, নির্দেশিকা, সহায়িকা, রান্না শেখার বই, এগুলি সাহিত্য নয়। একজন সাহিত্যিক ভাষার মাধ্যমে পাঠকের মনকে তাঁর কল্পনায় উদ্ভাবিত কোন স্থান-কালের পারিপার্শ্বিকতায় স্থাপন করেন, এবং সেই স্থান-কালের অসদ বাস্তবতা (virtual reality) তথা অসদ বিশ্বের (virtual world) মধ্যে ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে একটি কাল্পনিক ঘটনাপরম্পরা (Plot প্লট) উপস্থাপন করেন, যাতে একাধিক কাল্পনিক, মনস্তাত্ত্বিকভাবে জটিল ও আন্তঃসম্পর্কিত চরিত্রের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া ঘটে থাকে। সাহিত্যে ভাষার ব্যবহার দৈনন্দিন ভাষার ব্যবহারের চেয়ে ভিন্ন; একজন সাহিত্যিক একজন সাংবাদিকের সংবাদ প্রতিবেদনের মত ঘটনার নিরস বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা প্রদান করেন না, তিনি নান্দনিকতার স্বার্থে এবং পাঠকের মনে আবেগ ও আগ্রহ উদ্রেক করার লক্ষ্যে তাঁর লেখার ভাষাতে বিভিন্ন ধরনের অলঙ্কার ব্যবহার করেন, ভাষার ছন্দ, লয়, ওজন, ইত্যাদির সূক্ষ্ম তারতম্যের ব্যাপারে যত্নবান থাকেন, এবং চরিত্রগুলির গভীরতা ও ঘটনাগুলির গতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ করেন। একজন পাঠকের কাজ হল সাহিত্যিকের এই সৃষ্টি উপভোগ করার চেষ্টা করা। সাহিত্যের পারিপার্শ্বিকতা, ঘটনাপরম্পরা ও চরিত্রগুলি সম্পূর্ণ কল্পনাশ্রয়ী (ফিকশন) হতে পারে, কিংবা বাস্তবের কোনও ঘটনাকে (নন ফিকশন) নির্দেশ করতে পারে।

সাহিত্য কেবল রচিত বা লিখিত হয় না, ভাষার শৈল্পিক অভিব্যক্তি মৌখিকভাবে অর্থাৎ কথা বলার মাধ্যমেও প্রকাশ পেতে পারে। লিখন পদ্ধতির আবির্ভাব ও ব্যাপক প্রচলনের আগে মৌখিক সাহিত্যই ছিল সাহিত্যকলা। সেসময় মহাকাব্য, কিংবদন্তি, পৌরাণিক কাহিনী, গীতিকাব্য, মৌখিক কাব্য, লোকসাহিত্য—এ সবই মুখে মুখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হত। আজও বাগ্মিতা বা ভাষণদান মৌখিক সাহিত্যের অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়। বিংশ শতাব্দীতে এসে "কমিক" (ফরাসি Bande dessinée বঁদ দেসিনে "আঁকা পটি") নামের আরেক ধরনের সাহিত্যকলার আবির্ভাব ঘটে, যেখানে হাতে আঁকা ছবির সাথে পাঠ্য বর্ণনা ও কথোপকথন যোগ করে ও একের পর এক সাজিয়ে কোনও কাহিনীকে উপস্থাপন করা হয়; একে ফরাসি সাহিত্যাঙ্গনে "নবম শিল্প" হিসেবে গণ্য করা হয়।

পদ্য ও কাব্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে লেখা একটি কবিতা

কাব্যকলা হল এক ধরনের সাহিত্যকলা যার উদ্দেশ্য ভাষার সৃজনশীল ব্যবহারের মাধ্যমে চিন্তা, ধারণা, কাহিনী, অভিজ্ঞতা বা অনুভূতির এমন এক অর্থঘন শৈল্পিক অভিব্যক্তি সৃষ্টি করা, যেখানে বিশেষ বিশেষ শব্দ অর্থ, ধ্বনি, ধ্বনিদল, স্বরাঘাত ও ছন্দের বিভিন্ন মাপকাঠিতে সুনির্বাচিত করে ও নির্দিষ্ট পুনরাবৃত্ত বিন্যাসে একের পর এক সাজিয়ে, একাধিক পংক্তিতে ভেঙে ও কতগুলি পংক্তিকে একেকটি স্তবকে গুচ্ছবদ্ধ করে উপস্থাপন করা হয়। কাব্য লিখিত, উচ্চারিত এমনকি গীত হতে পারে। যিনি কাব্যকলার চর্চা করেন, তাকে কবি বলে আর তার সৃষ্টিকর্মকে কবিতা বা কাব্য বলে। শিল্পগুণ নির্বিশেষে সাধারণভাবে যেকোনও ছন্দোবদ্ধ রচনাকে পদ্য বলে।

কবিতা যেকোনও বিষয়বস্তুর উপর লিখিত হতে পারে, তবে সাধারণত আবেগের তীব্রতা, চিন্তার গভীরতা ও সূক্ষ্মতা কিংবা অভিব্যক্তির গাম্ভীর্য ভাষায় প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়লে কবিতার আশ্রয় নেয়া হয়। কবিতাতে প্রীতিকর ধ্বনির সাথে অর্থের অভিনবত্বের মেলবন্ধন ঘটে। অগম্ভীর, অগভীর বিষয়বস্তুর উপরে শিশুতোষ, গ্রামীণ লোকসংস্কৃতিজাত বা বিনোদনমূলক ক্ষুদ্র পদ্যকে সাধারণত ছড়া বলে। কোনও কোনও সাহিত্য সমালোচক ছড়া ও কাব্যের মধ্যে পার্থক্য করেন এই বলে যে ছড়া হল চতুর, যান্ত্রিক, অপরিশীলিত ও অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্গীয় রচনা, যার রচয়িতার কোনও শৈল্পিক উচ্চাভিলাষ নেই, বরং অতিচেনা বিষয়বস্তুকে কোনও ছন্দে বেঁধে ক্ষণস্থায়ী তৃপ্তি দেওয়াই যার মূল উদ্দেশ্য, অনেকটা পথনির্দেশকের মত; কিন্তু এর বিপরীতে কাব্য হল উচ্চমার্গীয়, অনুপ্রাণিত সৃষ্টিকর্ম, যার রচয়িতার উদ্দেশ্য ভাষার ক্ষমতা ও সম্ভাবনার সম্পূর্ণ প্রয়োগ ঘটিয়ে জটিল বাস্তবকে তুলে ধরার অভিলাষে অজানার পথে অপ্রত্যাশিতের অনুসন্ধান, অনেকটা দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর মত। কাব্যে বিনোদন নয়, বরং প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতাই মুখ্য। কবিতা রচনাতে একধরনের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব কাজ করে; কবি যেমন একদিকে গদ্যের তুলনায় অনেক কম শব্দ ব্যবহার করে ভাষার ব্যবহারে সংক্ষিপ্ততা ও সাশ্রয়ের দিকে মনোযোগী থাকেন, আবার অন্যদিকে ঐ কমসংখ্যক শব্দের মধ্যে কতটা সমৃদ্ধভাবে, কতটুকু কার্পণ্যহীনভাবে অর্থের দ্যোতনার প্রকাশ ঘটানো যায়, তার দিকেও খেয়াল রাখেন।

কাব্যকলাতে ভাষার ব্যবহার সাধারণ মুখের ভাষা ও লিখিত গদ্যের ভাষা থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভিন্ন হয়ে থাকে। কাব্যের প্রধান প্রধান উপাদানগুলি হল কবিতার বক্তা (অর্থাৎ কবিতায় কার বক্তব্য প্রকাশ পাচ্ছে; এটি কবি নিজে না-ও হতে পারেন), দৃশ্যমান পংক্তি ও স্তবকের দৈর্ঘ্য ও কাঠামো, বিষয়বস্তু, ভাব বা স্বর, প্রতীকীবাদ, ভাষার গাম্ভীর্য বা চটুলতা, শব্দচয়ন, শব্দের ক্রম ও অন্বয়, স্বরাঘাত, ছন্দ ও মিল, আলংকারিক ভাষা, শব্দের বাচ্যর্থ ও গূঢ়ার্থ, পুনরাবৃত্তি, পরিহাসমূলক বক্রোক্তি, অনুপ্রাস, স্বরসাদৃশ্য, ব্যঞ্জনসাদৃশ্য, রূপগত কাঠামো, নরত্বারোপ, উপমা, রূপক, অতিশয়োক্তি, পরোক্ষ উল্লেখ, ধ্বন্যাত্মক শব্দ, বাগধারা, প্রতীকাশ্রয়ী বর্ণনা, শ্রুতিমাধুর্য, শ্রুতিকটুতা, অর্থঘনত্ব, দৃষ্টি-শ্রুতি-স্বাদ-গন্ধ-স্পর্শের ইন্দ্রিয়সুখ উদ্রেককারী চিত্রকল্প, ইত্যাদি।

কবিতার বিভিন্ন প্রকারভেদগুলি হল ছন্দোবদ্ধ হেঁয়ালি (acrostic), অ-আ-ক-খ কবিতা (abc poem), আত্মজীবনীমূলক কবিতা, কাহিনীগাথামূলক কবিতা, পঞ্চপদী কবিতা, চতুর্পদী বা রুবাঈ কবিতা, দ্বিপদী শ্লোকবিশিষ্ট কবিতা, বর্ণিল কবিতা, হীরকাকৃতি কবিতা, মহিমাকীর্তনমূলক কবিতা, স্তবকবিতা, চৌদ্দপংক্তির কবিতা বা সনেট, কাহিনী কবিতা, মুক্তছন্দ কবিতা, গীতিকবিতা, সমাধিলিপি কবিতা,জাপানি তাংকা ও হাইকু, কেনিং কবিতা, শোকগাথা কবিতা, হারানোর ব্যথাবিদুর গজল, মহাকাব্য, ভিলানেল (ফরাসি ঊনিশ পংক্তির কবিতা), ইত্যাদি।

উত্তর আমেরিকা মহাদেশের কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে ২০শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বেশ কিছু নতুন ধরনের পরিবেশনভিত্তিক কবিতার ধরনের আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে আছে ১৯৭০-এর দশকে পশ্চিম ভারতীয় তথা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের রেগে সঙ্গীতের ছন্দের উপর ভিত্তি করে রচিত "ডাব" কবিতা, ১৯৭০-এর দশকের শেষভাগে নিউ ইয়র্ক নগরীর ব্রংক্স এলাকার কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনীদের হিপ-হপ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সঙ্গীত ও তালের পটভূমিতে উদ্ভূত "র‍্যাপ" কবিতা, ১৯৮০-র দশকে শিকাগোতে উদ্ভূত উপস্থিত দর্শকের অংশগ্রহণে প্রতিযোগিতামূলক "স্ল্যাম" কবিতা, ইত্যাদি।

গদ্য

গদ্য হল লিখিত ভাষার একটি রূপ যেটি পদ্যের মত শৈল্পিক রৌপ বিন্যাস (formal pattern) অনুযায়ী সুবিন্যস্ত থাকে না। যদিও গদ্যে এক ধরনের ছন্দ থাকতে পারে এবং এতে পুনরাবৃত্তি ও ভারসাম্য সৃষ্টিকারী কিছু কৌশল ব্যবহৃত হতে পারে, তদুপরি এগুলি পদ্যের মতো কোনও নিয়মিত ও দীর্ঘস্থায়ী রৌপ বিন্যাস দ্বারা শাসিত হয় না। পদ্যের মতো কোনও শৈল্পিক শৈলীর পছন্দ অনুযায়ী উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের ও সংখ্যার পংক্তিতে ভেঙে ভেঙে কিংবা অন্তমিল রেখে রেখে গদ্য রচিত হয় না। গদ্যের তাৎপর্যমূলক একক হল পূর্ণ বাক্য, পংক্তি নয়। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে লেখা হয় একটি পূর্ণ বাক্য, যা একটি সম্পূর্ণ চিন্তার বাহক। বাক্যগুলির ভেতরে শব্দের ক্রম ও বিন্যাসে পদ্যের মতো কোনও সৃজনশীলতা বা ছন্দ প্রয়োগ করা হয় না; এগুলি মোটামুটি স্থির থাকে ও এগুলি লেখার সময় কঠোরভাবে ব্যাকরণ ও বিরামচিহ্নের নিয়মাবলী মেনে চলা হয়। বাক্য লিখতে লিখতে পাতার কিনারায় চলে আসলে তবেই প্রয়োজনের তাগিদে নতুন পংক্তিতে সেটি অব্যাহত রাখা হয়, কোনও শৈল্পিক পছন্দের কারণে নয়। আবার কতগুলি বাক্যের গুচ্ছ নিয়ে তৈরি হয় অনুচ্ছেদ। অনুচ্ছেদগুলিকে দেখতে চতুর্ভুজাকার এক খণ্ড পাঠ্যের মতো লাগে। দীর্ঘ রচনা বা গ্রন্থের ক্ষেত্রে অনেকগুলি অনুচ্ছেদ মিলে একাধিক পৃষ্ঠাবিশিষ্ট একটি অধ্যায় গঠন করা হতে পারে। গদ্যে সাধারণত শব্দের অর্থ আক্ষরিক ও পরিস্কার বোধগম্য হয়ে থাকে, পদ্যের মতো কোনও গূঢ় অর্থ থাকে না। গদ্যের উদ্দেশ্য হতে পারে পাঠককে তথ্য প্রদান করা, যুক্তির মাধ্যমে পাঠককে কোনও মতের পক্ষে রাজি করানো কিংবা পাঠককে স্রেফ বিনোদন প্রদান করা।

গদ্যরচনাকে মূলত দুইভাগে ভাগ করা যায়। বাস্তবভিত্তিক গদ্য (Non-fiction) ও কল্পকাহিনী (Fiction)। যেসব গদ্যে বাস্তব ব্যক্তি, বস্তু, স্থান, ঘটনা বা অভিজ্ঞতার (অন্তত লেখার সময় সেগুলির বাস্তব অস্তিত্ব আছে বলে ধরে নেওয়া হয়) বিবরণ, ব্যাখ্যা, আলোচনা বা সেগুলি সম্পর্কে মতামত রচিত হয়, সেগুলিকে বাস্তবভিত্তিক গদ্য বলে। সংবাদপত্র বা সাময়িকীতে প্রকাশিত নিবন্ধ, প্রবন্ধ, সমালোচনা, বিজ্ঞাপন, রন্ধনপ্রণালী, প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, লিখিত বক্তৃতা, গবেষণাপত্র, চিঠিপত্র, স্মৃতিচারণমূলক রচনা ও গ্রন্থ, আত্মজীবনী, চুক্তি, দলিল, রোজনামচা বা দিনিলিপি, আইন, সংবিধান, হিতোপদেশ বা নসিহত, নির্দেশিকা গ্রন্থ, পাঠ্যপুস্তক, ইতিহাস, বাস্তব জীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বিবরণ, ইত্যাদি হল বাস্তব তথ্যভিত্তিক গদ্যের কিছু উদাহরণ। বাস্তব তথ্যভিত্তিক রচনা মানেই যে সত্য তা নয়, কেননা যেকোনও বাস্তব কোনও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সঠিক, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ রচনা অসম্ভব, কারণ যদিও এতে কল্পনার কোনও স্থান নেই, তা সত্ত্বেও লেখকের ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাস, পূর্ব-অভিজ্ঞতা ঐ রচনার উপর এক ধরনের ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রভাব ফেলতে পারে। বাস্তব তথ্যভিত্তিক গদ্যলেখক পাঠককে কোনও তথ্য প্রদান করেন কিংবা যুক্তি দিয়ে তার মন জয় করার চেষ্টা করেন।

পরিবেশন কলা

সঙ্গীত

ভারতীয় সেতার বাদনশিল্পী অনুষ্কা শঙ্করের সঙ্গীত পরিবেশনা

সঙ্গীতকলা বলতে সুর, ছন্দ, সুরসঙ্গতিকাঠামোর বিদ্যমান সাংস্কৃতিক রীতিনীতি মেনে কণ্ঠবাদ্যযন্ত্রের দ্বারা উৎপন্ন ধ্বনির সম্মিলন ঘটানো একটি পরিবেশন কলাকে বোঝায়, যার উদ্দেশ্য কানে শুনে উপভোগ্য নান্দনিক, শ্রুতিমধুর কোনও কিছু সৃষ্টি করা, যাতে অর্থবহ কোনও কিছু ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। সঙ্গীতকলায় উৎপাদিত শিল্পকর্মকে সঙ্গীত বলে। প্রতিটি মানব সমাজ ও সংস্কৃতিতেই সঙ্গীতকলা কোনও না কোনও ভাবে মিশে আছে। ধর্মীয় আচার, পূজা বা প্রার্থনা, নড়াচড়ায় সমন্বয় সাধন, যোগাযোগ ও কিংবা স্রেফ বিনোদনের মত বিভিন্ন সামাজিক উদ্দেশ্যে সঙ্গীত ব্যবহৃত হয়।

সঙ্গীত কণ্ঠস্বর বা বাদ্যযন্ত্র দিয়ে পরিবেশন করা হয়। বাদ্যযন্ত্রগুলিকে কয়েকটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়: ১) ততযন্ত্র (যেমন একতারা, সেতার, তানপুরা, গিটার, বেহালা, বীণা, সরোদ, ইত্যাদি), যেগুলিতে লাগানো শক্ত করে টানা তারে হালকা ঘা বা টান দিয়ে কিংবা ঘষে ঘষে স্বর উৎপাদন করা হয়। ২) শুষিরযন্ত্র (যেমন বাঁশি, শিঙা, ইত্যাদি), যেগুলির নলের ভেতরে ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয়। ৩) ঘাতযন্ত্র (যেমন তবলা, ঢোল, পাখওয়াজ, ঝুমঝুমি, ইত্যাদি) যেগুলিকে নাড়িয়ে বা আঘাত করে ছন্দ প্রদানকারী ধ্বনি তৈরি করা হয় (আনদ্ধযন্ত্রঘনযন্ত্র হল ঘাত বাদ্যযন্ত্রের দুইটি প্রধান উপশ্রেণী)। ৪) বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্র, যেগুলিতে বৈদ্যুতিক বা বৈদ্যুতিক উপায়ে ধ্বনি উৎপাদন করা হয় এবং ৫) চাবিফলক বাদ্যযন্ত্র (যেমন পিয়ানো, হারমোনিয়াম, অ্যাকর্ডিয়ন, ইত্যাদি) যেগুলির চাবিতে চাপ দিয়ে স্বর উৎপাদন করা হয়। কোনও সঙ্গীতকর্মে কোন্‌ বাদ্যযন্ত্র কখন, কোথায়, কতক্ষণ ব্যবহার করা হবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; এটিকে বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়সাধন (Instrumentation) বলা হয়।

সঙ্গীতের বিভিন্ন প্রকার আছে। যেমন ধ্রুপদী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত (ভারতীয় বা পশ্চিমা), লোকসঙ্গীত, ধর্মীয় সঙ্গীত, গীতিনাট্য (অপেরা), অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত ও সরল প্রকৃতির জনপ্রিয় সঙ্গীত যেমন - পপ, রক, হিপহপ, র‍্যাপ, জ্যাজ, ব্লুজ, বিশ্ব-সঙ্গীত, ইত্যাদি। বাঙালি সংস্কৃতিতে বিখ্যাত সুরকার-গীতিকারদের রচনাকৃত সঙ্গীত যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধ্যাত্মিক লোকসঙ্গীত যেমন বাউল সঙ্গীত, ইত্যাদি বহুল সমাদৃত। মানুষ মিলনায়তনের ভেতরে বা কিংবা খোলা আকাশের নিচে পরিবেশিত সঙ্গীত উপভোগ করে, চৌম্বক ক্যাসেট-সিডি-ডিভিডি-তে ধারণকৃত সঙ্গীত-সঙ্কলন ("অ্যালবাম") কিনে বা সরাসরি ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে (ডাউনলোড) সঙ্গীত-চালন যন্ত্র বা প্লেয়ারে কিংবা কম্পিউটারে শুনতে পারে, কিংবা বেতারে সম্প্রচারিত সঙ্গীত শুনতে পারে।

সঙ্গীতের চারটি মূল উপাদান হল সুর, ছন্দ, সুরসঙ্গতি এবং কাঠামো। সঙ্গীতকলায় ব্যবহৃত মৌলিক ধ্বনিগুলিকে স্বর (tone) বলে। বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলের সঙ্গীতে সাধারণত সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি - এই সাতটি প্রধান স্বর আছে এবং এদের বাইরে ৫টি গৌণ স্বর আছে। প্রতিটি স্বর আবার বিভিন্ন তীক্ষ্ণতার (pitch) হতে পারে। সঙ্গীতরচনার সময় বহুসংখ্যক উঁচু-নিচু বিভিন্ন রকমের স্বর একের পর এক সাজিয়ে শ্রুতিমধুর স্বর-পরম্পরা সৃষ্টি করা হয়, যাকে সুর বা সুতান (melody) বলে। সুরের পরে সুর যোগ করে শেষ পর্যন্ত তৈরি হয় পূর্ণ একটি সঙ্গীতকর্ম।

স্বরগুলিকে আবার স্পন্দন, মাত্রা, লয়, তাল ও ছন্দের মাধ্যমে অতিবাহত সময়ের সাপেক্ষে সুবিন্যস্ত করা হয়। ছন্দ হল সঙ্গীতের প্রতিটি স্বর কতক্ষণ স্থায়ী হয় এবং বিভিন্ন স্থায়িত্বের স্বর কীরকম বিন্যাসে একে অপরের সাথে বসে, তার বর্ণনা। কোনও নির্দিষ্ট স্থায়িত্ব ও তীক্ষ্ণতার স্বরকে স্বরলিপিতে যে চিহ্ন দ্বারা প্রকাশ করা হয়, তাকে স্বরচিহ্ন (note) বলে। সঙ্গীতকর্মের পটভূমিতে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে এক ধরনের নিয়মিত অবিরাম স্পন্দন (pulse) থাকে। কিছু স্পন্দনে নিয়মিতভাবে ঝোঁক বা ঠোকা পড়ে; এগুলিকে মাত্রা (beat) বলে। মাত্রাগুলি কত আস্তে বা দ্রুত পড়ছে, সেই দ্রুতিকে লয় (tempo) বলে। স্বরচিহ্ন ও মাত্রাগুলি যে নির্দিষ্ট নিয়মে বিন্যস্ত থাকে, তাকে তাল (meter) বলে। ঢোল, তবলা, ড্রাম, ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র ও গায়ককে ছন্দ ধরে রাখতে সাহায্য করে।

পশ্চিমা সঙ্গীত রচনায় শুধু সময়ের সাথে সাথে সামনের দিকে বহমান সুরই থাকে না, বরং এই মূল সুররেখাকে (melodic line) সঙ্গ দেবার জন্য এর নিচের স্তরে অনেক সহায়ক স্বর বাজানো বা গাওয়া হয়। এগুলিকে সঙ্গত (accompaniment) বলে। অনেক সময় একই মুহূর্তে একাধিক সহায়ক স্বরের একটি দলকে সম্মিলিতভাবে বাজানো হয়, যাকে স্বরঝংকার (chord) বলে। সাধারণত মূল সুরের পটভূমিতে একের পর এক স্বরঝঙ্কার বাজানো হয়, যাকে স্বরঝঙ্কার প্রগমন (chord progression) বলে। সঙ্গীতের এই বৈশিষ্ট্যটিকে ঐকতান বা সুরসঙ্গতি (harmony) বলে। ঐকতান বা সুরসঙ্গতির কাজ হল মূল সুরকে ভাব, গভীরতা ও বর্ণময়তা প্রদান করা। পাশ্চাত্যে সঙ্গীতের ইতিহাসে রেনেসাঁস ও বারোক পর্বে নতুন একটি কৌশল উদ্ভাবিত হয়, যেখানে একটি সুরের ফাঁকে ফাঁকে সমান প্রাধান্যবিশিষ্ট আরেকটি সুর সংযোজন করা হয়; এই ব্যাপারটিকে প্রতিসুর (counterpoint) বলে।

সুরের ক্ষুদ্র স্বতন্ত্র অংশবিশেষকে সুরখণ্ড (melodic phrase) বলে। একাধিক সুরখণ্ড মিলে একটি সঙ্গীতখণ্ড (section) গঠন করে। সঙ্গীতখণ্ডগুলি একে অপরের থেকে সুর, তাল-লয়-ছন্দ, ঐকতান, প্রাবল্য, তীক্ষ্ণতা, উপস্থিত বাদ্যযন্ত্রের সংখ্যা ও প্রকার, গানের কথা, ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকে আলাদা হতে পারে; এই ব্যাপারটিকে বৈসাদৃশ্য (Constrast) বলে। একটি সুরখণ্ডকে কিছু সময় পরপর পুনরায় বাজানো হতে পারে, যাকে পুনরাবৃত্তি বলে। তবে একটি সঙ্গীতকর্মের সুর সাধারণত একটি বিশেষ স্বরগ্রাম (Scale), ঠাট (mode) কিংবা রাগের (বিশেষ ভাব বা অনুভূতি প্রকাশকারী স্বরসমষ্টি) উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি করা হয়; এই ব্যাপারটিকে ধারাবাহিকতা (Continuity) বলে। সঙ্গীত রচনা করার সময় সুর, ছন্দ, ঐকতান, প্রতিসুর, ইত্যাদি উপাদানগুলিকে একত্র করে বৈসাদৃশ্য, পুনরাবৃত্তি ও ধারাবাহিকতার মূলনীতিগুলি মাথায় রেখে অনেকগুলি সুরখণ্ড একের পর এক যে ক্রমবিন্যাসে সাজিয়ে একটি সম্পূর্ণ সঙ্গীতকর্ম সৃষ্টি করা হয়, তাকে সঙ্গীতের কাঠামো (Form) বলে। যেমন - পাশ্চাত্যের জনপ্রিয় "পপ" সঙ্গীতে ভূমিকা, স্তবক, প্রাক-সমবেত, সমবেত, স্তবক, প্রাক-সমবেত, সমবেত, পরিবর্তন, সমবেত, উপসংহার (Intro-Verse-Prechorus-Chorus-Verse-Prechorus-Chorus-Transition-Chorus-Outro)--- এই কাঠামোটি খুবই প্রচলিত। কদাচিৎ শেষ সমবেত অংশের ঠিক আগে একটি একক যন্ত্রবাদন অংশ (instrumental) থাকতে পারে। এর বিপরীতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ধ্রুপদ শৈলীতে প্রথমে ষড়জ স্বর থেকে শুরু করা ধীর লয়ের আলাপ দিয়ে গান শুরু হয়, যাতে শিল্পী রাগের বিভিন্ন দিক শ্রোতার কাছে মেলে ধরেন; এরপর স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ এই চারটি কলি/স্তবক/তুক/ধাতু/বিভাগ একের পর এক গাওয়া হয় ও সবশেষে স্থায়ীতে ফিরে গান শেষ হয়। বাংলা আধুনিক গান বা কাব্যসঙ্গীতে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, নজরুল ইসলাম, এই পাঁচ গীতিকবির সৃষ্ট গানের ধারা) ধ্রুপদের মতো স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ - এই চারটি ভাগ রয়েছে। অনেক সময় সঙ্গীতের শুরুতে পূর্বরাগমূলক (prelude) ও সঙ্গীতের স্তবকগুলির মাঝে মাঝে সেগুলির একটি থেকে আরেকটি উত্তরণ করানোর জন্য বিরতিমূলক (interlude) যন্ত্রবাদন করা হতে পারে।

সঙ্গীতের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে, যেমন ধ্বনিগুণ, ধ্বনিতীব্রতা সংশ্রয়, সুরভাব এবং বুনট। ধ্বনিগুণ বা ধ্বনিমুদ্রা (Timbre) হল সেই উপাদান, যার সুবাদে সঙ্গীতকর্মের অভ্যন্তরের কোন্‌ ধ্বনি কোন্‌ বাদ্যযন্ত্র বা কোন্‌ গায়কের কণ্ঠ থেকে উৎপাদিত হচ্ছে, তা পৃথক করে চিহ্নিত করা যায়। যেমন একজন শ্রোতা একই সুরে, একই তীক্ষ্মতা ও একই উচ্চতা বা প্রাবল্যে বাজানো সেতার, বেহালা, বাঁশি ও হারমোনিয়ামের মধ্যে যে কারণে পার্থক্য করতে পারেন, কিংবা একই সুরে গাইতে থাকা দুইজন গায়কের গলার কণ্ঠের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন, তা হল তাদের ধ্বনিগুণের পার্থক্য। গায়কের কণ্ঠ বা বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনিগুণকে ধারালো (sharp), ভরাট (round), বাঁশিসুলভ (reedy), শীর্ণ (thin), উৎফুল্ল (bright), বিষণ্ণ (dark), পিতলসুলভ বা খ্যানখেনে (brassy), কর্কশ (harsh), গুনগুনে বা ভনভনে (buzzy), খনখনে বা চড়া (shrill), মধুরগম্ভীর (mellow), টানটান (strained), বিশুদ্ধ (pure), বিকৃত (distorted), খরখরে (raspy), ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে চরিত্রায়িত করা হতে পারে। ধ্বনিতীব্রতা সংশ্রয় (Dynamics) সঙ্গীতের এক ধরনের অভিব্যক্তিমূলক উপাদান, যেখানে সঙ্গীতকর্মের নির্দিষ্ট অবস্থানে উৎপাদিত ধ্বনির তীব্রতা বা প্রাবল্য কমিয়ে বাড়িয়ে বিশেষ অনুভূতি প্রকাশ করা হয়; অন্য ভাষায়, সঙ্গীতকর্মটির অংশবিশেষ কি তীব্র বা জোরালো নাকি কোমল প্রকৃতির, তা এই উপাদানের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সঙ্গীতে ধ্বনিতীব্রতাকে অতিতীব্র (fortissimo), তীব্র (forte), অর্ধতীব্র (mezzoforte), অর্ধকোমল (mezzopiano), কোমল (piano), অতিকোমল (pianissimo), আরোহী (crescendo) ও অবরোহী (decrescendo) বিশেষণগুলি দিয়ে চরিত্রায়িত করা হয়। আবার, কোনও সঙ্গীতকর্মের স্বর, সুর, সুরসঙ্গতি ও স্বরঝংকারগুলিকে এক ধরনের পারস্পরিক আধিপত্য-আনুগত্য সম্পর্কে বিন্যস্ত করা হয়, যে সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট স্বরদলকে (key) আধিপত্য প্রদান করা হয়; সঙ্গীতকর্মটি ঐ স্বরদলের নীড়স্বরে বা ষড়জ স্বরে (Tonic) শুরু হয়ে সেটির সাথে প্রণালীবদ্ধভাবে সম্পর্ক রেখে স্থিতিশীলতা, আকর্ষণ, অভিমুখিতা, ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে বাজতে থাকে এবং অন্তিম মুহূর্তে সাধারণত নীড়স্বরে গিয়ে সঙ্গীতকর্মটির উপসংহারমূলক (Resolution) পতন (Cadence) হয়। আবার কখনও কখনও সঙ্গীতকর্মের মাঝখানে অন্য একটি ঘনিষ্ঠ তথা প্রত্যক্ষ সম্পর্কযুক্ত অথবা দূরবর্তী কোনও স্বরদলকে আধিপত্য দান করা হতে পারে, যাকে সুরের পর্দাবদল (modulation) বলে। সঙ্গীতকর্মের এই উপাদানটিকে এর সুরভাব (Tonality) বলে। কোনও সঙ্গীতকর্ম পরিবেশনের সময় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রগুলি যেভাবে কখনও কখনও একে অপরের সাথে সংযোজিত হয়ে বা একে অপরের থেকে বিয়োজিত হয়ে যে সামগ্রিক স্তরীভূত ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে, তাকে সঙ্গীতের বুনট (Texture) বলে। সঙ্গীত চলাকালে বাদ্যযন্ত্র ও গায়কের সংখ্যা, এদের বিভিন্ন ধ্বনিগুণ, এদের মধ্যকার সুরসঙ্গতি, স্বাধীনতা কিংবা অনুকরণশীলতা, এদের মধ্যে ছন্দ ও লয়ের তারতম্য, ইত্যাদি সঙ্গীতের বুনটকে ঘন (thick), লঘু (light), স্তরীভূত (layered), সমধ্বনিক (homophonic), একধ্বনিক (monophonic), বহুধ্বনিক (polyphonic), মিশ্রধ্বনিক (heterophonic), সমছান্দিক (homorhythmic), বহুছান্দিক (polyrhythmic), ইত্যাদি চরিত্র প্রদান করে। সাধারণত কোনও গানের প্রাক-সমবেত অংশে সাঙ্গীতিক বুনট উত্তরোত্তর ঘন হতে থাকে এবং সমবেত অংশে গিয়ে সবচেয়ে ঘন হয়।

নৃত্য

একজন ওড়িশি নৃত্যশিল্পী

নৃত্য হল পটভূমিতে অবস্থিত সঙ্গীতের সাথে সাথে নির্দিষ্ট বিন্যাসে ছন্দে ছন্দে দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঞ্চালন করার পরিবেশন কলা। নৃত্য মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশের প্রাচীনতম রূপগুলির একটি। সারা বিশ্ব জুড়ে সব সংস্কৃতিতে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে নৃত্য পরিবেশন করা হয়। জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু, ইত্যাদি বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ হিসেবে মানুষ নাচতে পারে। আবার অনেক সংস্কৃতিতে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক কারণে মানুষ নাচতে পারে। দেবতা বা ঈশ্বরের প্রার্থনা, রোগমুক্তি, আবহাওয়ার পরিবর্তন, ইত্যাদির জন্য নাচ পরিবেশিত হতে পারে। শিল্পকলার দৃষ্টিকোণ থেকে কোনও আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে, কোনও কাহিনীর বর্ণনা দিতে কিংবা কেবল বিনোদনের স্বার্থে নৃত্য পরিবেশন করা হতে পারে।

মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মনের বিভিন্ন ভাব প্রকাশের সময় বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়ায় কিংবা চলাফেরা করে। নৃত্যকলাতে এই সব সাধারণ ব্যবহারিক অঙ্গ সঞ্চালনগুলিকে রূপান্তরিত করে অন্যরকম অসাধারণ রূপ দান করা হয়। সব মানুষই হাঁটে, কিন্তু নৃত্যে এই হাঁটার প্রক্রিয়াটি হয়ত ছন্দে ছন্দে বা নির্দিষ্ট কোনও জ্যামিতিক বিন্যাসে সম্পাদন করা হয়। কিছু কিছু প্রকারের নৃত্যে অঙ্গসঞ্চালনের বিভিন্ন কৌশলগুলি আগে থেকেই স্থির করা থাকে, যেগুলির কোনও অর্থ নেই; যেমন ব্যালে নৃত্য কিংবা ইউরোপীয় লোকনৃত্য। আবার অন্য কিছু প্রকারের নৃত্যে মূকাভিনয় ও প্রতীকী অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করা হতে পারে, যেমন এশিয়ার বহু ধরনের নৃত্যে এগুলি দেখতে পাওয়া যায়। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ভিন্ন ভিন্ন কারণে ও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের নেচে থাকে। নাচ থেকে তাই কোনও মানব সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও জীবনধারা সম্পর্কে ধারণা করা যায়।

নৃত্যের মৌলিক উপাদানগুলি হল: দেহ, নড়ন-চলন, স্থান, কাল, শক্তি ও সম্পর্ক। নাচের ক্ষেত্রে দেহের বিভিন্ন অংশ যেমন মাথা, চোখ, ধড়, হাত, পা, আঙুল, ইত্যাদি দিয়ে আবেগ প্রকাশ করা হয়, ভারসাম্য বজায় রাখা হয় কিংবা প্রতীকী কিছু প্রকাশ করা হয়। এছাড়া দেহকে নির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় ধরে রেখে নির্দিষ্ট আকৃতি প্রদান করা যায়। নড়ন-চলন বলতে এক স্থান থেকে অন্য কোন স্থানে যাওয়ার বিভিন্ন উপায় (যেমন হাঁটা, দৌড়ানো, লাফানো, গড়ানো, ঘষটানো, ইত্যাদি) এবং এক জায়গায় স্থির থেকে দেহের অক্ষের চারপাশে অঙ্গচালনা করা (যেমন বাঁকা হওয়া, মোচড়ানো, টান টান করা, ধাক্কা দেওয়া, টান দেওয়া, দোলা, ঝাঁকি দেওয়া, ঘোরা, লাথি, ওঠা, বসা, শোয়া, ইত্যাদি) - এই দুই ধরনের কাজকে বোঝায়। নাচ শুধুমাত্র বহুসংখ্যক নড়ন বা অঙ্গভঙ্গির পরিকল্পিত (কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত) ধারাই নয়, এগুলির মাঝে মাঝে বিরতি ও আপেক্ষিক স্থির ভঙ্গিগুলিও নাচের অন্যতম উপাদান। নাচ পরিবেশন করার জন্য বড়সড় উন্মুক্ত, প্রতিবন্ধকতাহীন স্থানের দরকার হয়, যাতে এক বা একাধিক নৃত্যশিল্পী তাদের নাচের নড়াচড়াগুলি আরামদায়কভাবে সম্পাদন করতে পারে এবং দর্শকরাও সেগুলিকে স্পষ্টভাবে উপভোগ করতে পারে। একজন নর্তক বা নর্তকী নাচের বিস্তার, পথ, অভিমুখ, উচ্চতা, ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে তার আশেপাশের ত্রিমাত্রিক স্থানের সাথে বিভিন্ন ধরনের আন্তঃক্রিয়া সম্পাদন করে থাকেন। কাল বা সময়ের সাথে নাচের সম্পর্ক হল দ্রুতি বা লয় (কত দ্রুত নাচ করা হচ্ছে) এবং ছন্দ (নাচের বিভিন্ন মুদ্রার স্থায়িত্ব কী রকম)। নৃত্যকলায় শক্তি বলতে ওজন, নড়াচড়ার বা চলনের প্রবাহ (সদা প্রবহমান ও মুক্ত কিংবা নিয়ন্ত্রিত ও বদ্ধ), নড়াচড়ার বৈশিষ্ট্য (তীক্ষ্ণ, মসৃণ, স্বচ্ছন্দ, হালকা, ভারী, ঝুলন্ত, পড়ন্ত, আঁটোসাটো, শিথিল, ইত্যাদি) -- এই ব্যাপারগুলিকে বোঝায়। সম্পর্ক বলতে অন্যান্য নৃত্যশিল্পীর সাপেক্ষে দৈহিক আকৃতি ও অবস্থান, নড়ন ও চলনের বিন্যাস, ছন্দ, ইত্যাদি আন্তঃসম্পর্ককে বোঝায়।

নাট্যকলা

একটি মঞ্চায়িত নাটকের স্থিরদৃশ্য

নাট্যকলা বলতে এক ধরনের পরিবেশন কলাকে বোঝায় যেখানে একাধিক অভিনেতা ও অভিনেত্রী উপস্থিত প্রত্যক্ষ দর্শক-শ্রোতার সম্মুখে সাধারণত একটি মঞ্চের উপরে কোনও একটি বাস্তবঘনিষ্ঠ বা কাল্পনিক ঘটনাপরম্পরা (সাধারণত পূর্বরচিত নাট্যকর্ম থেকে গৃহীত ও পরিমার্জিত পাণ্ডুলিপির উপর ভিত্তি করে) অঙ্গভঙ্গি, কথোপকথন, গান, সঙ্গীত, নাচ, ইত্যাদির সমন্বয়ে পরিবেশন করেন। কাহিনীটিকে আরও প্রাণবন্ত ও কাছের মনে করানোর জন্য আলোকসম্পাত, বিশেষ শব্দ, পটভূমিতে অঙ্কিত দৃশ্য, মঞ্চে স্থাপিত আসবাবপত্র, ইত্যাদির সহায়তা নেওয়া হতে পারে। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাদের ভাষা, বাচনভঙ্গি, ইশারা, অঙ্গভঙ্গি, চলাফেরা, ইত্যাদির মাধ্যমে নাটকের চরিত্রগুলিকে ফুটিয়ে তোলেন। তবে নাট্যকলা কেবল অভিনেতা অভিনেত্রীদের পরিবেশন দিয়েই সম্পন্ন হয় না। তাদের সাথে সহায়ক শিল্পী হিসেবে নর্তক-নর্তকী,গায়ক-গায়িকার দল থাকতে পারে। এছাড়া তাদের পেছনে কারিগরী কর্মীরা পোশাকপরিচ্ছদ ও বেশভুষা, দৃশ্যাবলি, আলোকসম্পাত, আসবাব নির্মাণ, ইত্যাদি কাজে সহায়তা করে। ব্যবসায়ীরা নাট্যপ্রকল্পটির অর্থায়ন, সংগঠন, বিপণন ও বিক্রয়ের ব্যাপারগুলি দেখাশোনা করে। সাধারণত একজন নাট্য প্রযোজক নাট্যপ্রকল্পটি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করেন; তিনিই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। নাট্য পরিচালক নাটকের মহড়ার পরিচালনা করেন, নাটকের পাণ্ডুলিপিকে মঞ্চে পরিবেশনের উপযোগী করে রূপায়ন করেন, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নির্বাচন করেন, বেশভুষা ও দৃশ্যাবলির নকশা কী রকম হবে, সেগুলির নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেন। পরিচালকের অধীনে একজন মঞ্চ ব্যবস্থাপক ও তার একাধিক সহকারী মহড়ার আয়োজন দেখাশোনা করেন ও কারিগরি দিকগুলি (যেমন আলোকসম্পাত, পর্দার খোলা বা বন্ধ হওয়া, বিশেষ ধ্বনি বা শব্দ সৃষ্টি, ইত্যাদি) নজরে রাখেন। নাট্যকলার সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল দর্শক-শ্রোতাবৃন্দ; পরিবেশিত নাটকটি শিল্প হিসেবে কতটুকু সফল, তাদের প্রতিক্রিয়াই অনেকাংশে সে ব্যাপারটি নির্ধারণ করে।

পাশ্চাত্যে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে প্রাচীন গ্রিসের অ্যাথেন্স শহরে পরিবেশন কলা হিসেবে নাট্যকলার আবির্ভাব ঘটে বলে মনে করা হয়। প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত নাট্যকলা সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে বা তারও আগে শুরু হয়েছিল। প্রাচীন চীনে সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১ সহস্রাব্দেরও আগে শাং রাজবংশের আমলে ধর্মীয় ওঝাদের আচারানুষ্ঠান হিসেবে এক ধরনের নাট্যকলা প্রচলিত ছিল।

নাচগাননির্ভর মঞ্চনাটক, গীতিনাট্য ও যাত্রা

ফরাসি গীতিনাট্য কার্মেন-এর একটি পরিবেশনা (২০০৮)

কোনও মঞ্চে পরিবেশিত নাটকে যখন নাচ, গান, কথোপকথন ও অভিনয়ের সম্মেলনে কোনও (সাধারণত আবেগধর্মী, হাস্যরসাত্মক ও মিলনাত্মক) কাহিনী বর্ণিত হয়, তখন তাকে নাচগাননির্ভর মঞ্চনাটক (ইংরেজিতে Musical theater মিউজিকাল থিয়েটার) বলে। আবার কোনও নাট্যকর্মের প্রায় সম্পূর্ণ কাহিনীই বাদকদলের ধ্রুপদী সঙ্গীত বাজনার সাহচর্যে অভিনয়পটু কণ্ঠশিল্পীদের একাধিক গান গাওয়ার (কদাচিৎ ব্যালে জাতীয় ধ্রুপদী নৃত্য পরিবেশনাসহ) মাধ্যমে পরিবেশন করা হয় , তখন তাকে গীতিনাট্য (ইংরেজি Opera অপেরা) বলে। পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে লোকনাট্যের একটি বিশিষ্ট শাখা হলো যাত্রা, যেখানে কোনও ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, নীতিকথামূলক বা প্রণয়মূলক কাহিনীকে নাটকের রূপ দিয়ে খোলা আসরে উচ্চকণ্ঠে অভিনয়, সঙ্গীত ও বাদ্য সহকারে পরিবেশন করা হয়।

মিলানের লা স্কালা, প্যারিসের ওপেরা গার্নিয়ে, লন্ডনের রয়াল অপেরা, ভিয়েনার রাষ্ট্রীয় অপেরা, জার্মানির বায়রয়টের ফেস্টষ্পিলে ও নিউ ইয়র্ক শহরের মেট্রোপলিটান অপেরা ভবনগুলি পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে সুপরিচিত কয়েকটি গীতিনাট্যশালা। পশ্চিমা গীতিনাট্য বা অপেরা ইতালিতে বিশেষত ফিওরেন্তিনা (ফ্লোরেন্স) শহরে ১৭শ শতকে উৎপত্তিলাভ করে। ১৮শ শতকের মধ্যভাগে এটির একটি ধ্রুপদী শৈলী গড়ে ওঠে, এসময় মোৎসার্ট এই পরিবেশন কলাটির ব্যাপক উন্নতিসাধন করেন। ১৯শ শতকে ভের্দি ও ভাগনার গীতিনাট্যের দুই প্রধান দিকপাল ছিলেন। পশ্চিমা গীতিনাট্যে মানুষের আচরণের চরম ব্যাপারগুলি ফুটিয়ে তোলা হয়। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক জীবনের নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও মানবমনের অন্তরঙ্গ আবেগগুলি জমকালোভাবে পরিবেশন করা হয় এই মাধ্যমটিতে।

মূকাভিনয় ও ভাঁড়ামি

একজন মূকাভিনয় শিল্পী

মূকাভিনয় বলতে এক ধরনের নাট্যপরিবেশন কলাকে বোঝায় যেখানে শুধুমাত্র অভিব্যক্তিমূলক দৈহিক নড়নচড়ন ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কোনও কাহিনী বলা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে গ্রিসে হাস্যরসাত্মক বিনোদন হিসেবে মূকাভিনয়ের প্রচলন ছিল, তবে এগুলির সাথে গানবাজনা ও কথোপকথনও যুক্ত থাকতো। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে রোমেও মূকাভিনয়ের প্রচলন হয়, তবে সেগুলিতে স্থূল, কামুক ও অশ্লীল বিষয়াবলি স্থান পেত। রোমান নির্বাক অভিনয় আরও উঁচুদরের ছিল, যেখানে মুখোশের ব্যবহার হত এবং দেহের ভঙ্গিমা ও হাতের মুদ্রার মাধ্যমে অভিব্যক্তি প্রকাশ পেত। এশিয়া মহাদেশের নাট্যকলাতেও প্রাচীনকাল থেকে মূকাভিনয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চীন ও জাপানের প্রধান প্রধান নাট্যরূপে মূকাভিনয়ের মর্যাদা গুরুত্বপূর্ণ। রোমান নির্বাক অভিনয়ের ঐতিহ্যটি ১৬শ শতকে এসে কোম্মেদিয়া দেল্লার্তে-তে রূপান্তরিত হয় এবং সেটি আবার ১৮শ শতকে ফরাসি ও ইংরেজ হাস্যরসাত্মক বিরতিগুলিকে প্রভাবিত করে। এগুলি পরবর্তীতে ১৯শ শতকীয় নির্বাক অভিনয়ের জন্ম দেয়, যাতে শিশুদের বিনোদন প্রদান ও জাঁকজমকপূর্ণতা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। আধুনিক পশ্চিমা মূকাভিনয় একটি বিশুদ্ধ নির্বাক শিল্পকলা যাতে অঙ্গভঙ্গি, নড়নচড়ন ও মুখাভিব্যক্তির মাধ্যমে অর্থবহ বার্তা জ্ঞাপন করা হয়। ২০শ শতকের বিখ্যাত মূকাভিনেতাদের মধ্যে জঁ-গাস্পার দ্যব্যুরো, এতিয়েন দ্যক্রু এবং মার্সেল মার্সো উল্লেখ্য। দ্যক্রু মূকাভিনয়ে ব্যবহৃত অঙ্গভঙ্গিগুলির একটি প্রণালীবদ্ধ ভাষা নির্মাণ করেন। এছাড়া চার্লি চ্যাপলিন, সিড সিজার ও সার্কাসের ভাঁড় এমেট কেলি-ও সার্থক মূকাভিনেতা ছিলেন।

পাশ্চাত্যে ভ্রাম্যমাণ বিনোদন প্রদর্শনী (সার্কাস) বা মূকাভিনয়ের আলোচনায় ভাঁড় বা সঙ (ক্লাউন) বলতে লালরঙা কৃত্রিম নাক, উজ্জ্বল রঙিন পরচুলা, সাদা রঙে ঢাকা মুখ ও অদ্ভুত রঙবাহারি পোশাক পরিহিত বিশেষ এক ধরনের মূকাভিনেতাদের বোঝায়, যারা হাস্যকর, উদ্ভট, স্থূল আচরণ করে হাসির উদ্রেক করে। ঐতিহ্যবাহী বোকা ভাঁড় বা বিদূষকের বিপরীতে সঙরা সাধারণত স্থূল রসিকতা, কিম্ভূতকিমাকার অদ্ভুত সব পরিস্থিতি ও প্রাণবন্ত দৈহিক নড়াচড়া সংবলিত কিছু পূর্ব থেকে স্থির করা কর্মকাণ্ড মূকাভিনয় করে দেখায়।

পুতুল নাচ

একটি পুতুল নাচ পরিবেশনা

পুতুল নাচ কলাটিতে একজন শিল্পী (যাকে পুতুল নাচশিল্পী বলে) এক বা একাধিক জড় পুতুলকে কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করে এমন একটি দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করেন যাতে মনে হয় যে পুতুল(গুলি) জীবন্ত। পুতুলগুলি প্রায়শই মানুষ, প্রাণী বা কিংবদন্তির কোনও জীবের আকৃতি ধারণ করে। পুতুল নাচশিল্পী দর্শকশ্রোতাদের কাছে দৃশ্যমান বা অদৃশ্য থাকতে পারেন। পুতুল নাচশিল্পী সুতা, দড়ি, তার, দণ্ড বা ইলেকট্রনীয় পদ্ধতিতে পুতুল নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কিংবা নিজের হাত পুতুলের ভেতরে রেখে বা কিংবা বাইরে থেকে হাত দিয়ে ধরে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কোনও কোনও পুতুল নাচে একাধিক পুতুল নাচ শিল্পী একটি মাত্র পুতুল চরিত্র সৃষ্টিতে কাজ করতে পারেন।

পুতুল নাচশিল্পীর ভূমিকা হল জড় পুতুলটিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাতে দর্শকশ্রোতার মনে হয় যে পুতুলটিতে প্রাণ ভর করেছে। কখনও কখনও পুতুল নাচশিল্পী নিজেও মঞ্চে পুতুলের সাথে একত্রে উপস্থিত হতে পারেন; এক্ষেত্রে পুতুল নাচশিল্পীর অভিনয় ক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

পুতুল নাচশিল্পী পুতুলের চরিত্রের হয়ে কথা বলতে পারেন এবং এসময় পুতুলের মুখের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করেন যেন মনে হয় পুতুলটিই কথা বলছে। তবে অনেক পুতুল নাচেই পুতুলের মুখের নড়াচড়া গৌণ; কেবল কোনও অনুভূতি বা অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য এটি সম্পাদন করা হয় এবং সাধারণ কথোপকথনে এর ব্যবহার নেই। ঐতিহ্যবাহী দস্তানাভিত্তিক পুতুলনাচে একজন পুতুলনাচশিল্পী অনেকগুলি পুতুল চরিত্রের মধ্যে একেক বারে দুইটি করে পুতুল নিয়ন্ত্রণ করেন। পুতুলনাচের একটি বড় অংশ কোনও কথাবার্তা ছাড়াই কেবলমাত্র নড়াচড়ার উপরে জোর দিয়ে সম্পাদন করা হয়।

ছায়ানাটকে কেবলমাত্র পর্দায় পুতুলের ছায়া দৃশ্যমান হয়। পর্দাটি পুতুল ও দর্শকশ্রোতার মাঝখানে স্থাপিত থাকে।

পুতুলনাচশিল্পী ও পুতুল নির্মাতার মধ্যে সম্পর্ক হল একজন অভিনেতা ও একজন নাট্যকারের মধ্যে সম্পর্কের মতো। পুতুল নির্মাতা একজন পুতুল নাচশিল্পীর জন্য পুতুল নকশা করেন। তবে প্রায়শই পুতুলনাচশিল্পী একাই পুতুল নির্মাতা, পরিচালক, নকশাবিদ, লেখক ও পরিবেশক --- এই সবগুলি ভূমিকাই যৌথভাবে পালন করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে একজন পুতুলনাচশিল্পী একজন পূর্ণাঙ্গ নাট্যচর্চাবিদ, কেননা সাধারণত নাট্যকলায় একজন নাটক লেখেন, আরেকজন সেটি পরিচালনা করেন এবং অভিনেতারা সেটি পরিবেশন করেন।

পুতুলনাচ একটি জটিল মাধ্যম যাতে সরাসরি দর্শকসমক্ষে পরিবেশনার পাশাপাশি কখনও কখনও থামা-কাঠামোভিত্তিক (স্টপ ফ্রেম) পুতুলনাচের চলমান চিত্র ও চলচ্চিত্রও সৃষ্টি করা হতে পারে, যেখানে পুতুল নাচ পরিবেশনাগুলিকে কারিগরিভাবে গতিবিধি ধারণ, কম্পিউটার-উৎপাদিত দৃশ্যাবলী (সিজিআই) বা অসদ্‌ পুতুলনাচ (ভার্চুয়াল পাপেট্রি) হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করা হতে পারে।

কসরতবাজি

সাইকেলের উপরে চীনা কসরতবিদদের ভারসাম্যের খেলা পরিবেশনা

কসরতবাজি বা দড়াবাজি বলতে শরীরের নড়াচড়া, ভারসাম্য, ক্ষিপ্রতা, ইত্যাদির দক্ষ ও সমন্বিত ব্যবহারের মাধ্যমে শূন্যে লাফ, ডিগবাজি, ঝুলে থাকা, রণপা দিয়ে হাঁটা, বহু উঁচুতে টানা দড়ির উপরে হাঁটা, ইত্যাদি কর্মকাণ্ডভিত্তিক এক বিশেষ ধরনের পরিবেশন কলাকে বোঝানো হয়। কসরতবিদেরা খুঁটি, এক বা দুই চাকার যান, বল, পিপা, টানা দড়ি, রজ্জু, তার, স্থিতিস্থাপক লম্ফমঞ্চ (ট্র্যাম্পোলিন), ঝুলন্ত দোলনদণ্ড (ফ্লাইং ট্র্যাপিজ), রণপা, ইত্যাদি সরঞ্জামের সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের দৈহিক কসরত প্রদর্শন করেন। উম্মুক্ত মেলার মাঠে, ভ্রাম্যমাণ তাঁবুর রঙ্গালয়ে (সার্কাস) ও মঞ্চশালায় কসরতবাজি প্রদর্শিত হতে পারে। আধুনিক শারীরক্রীড়া (জিমনাস্টিকস), আধুনিক নৃত্যের কিছু ধরন (মডার্ন ড্যান্স) ও কিছু মঞ্চনাটকের ধরন যেমন পিকিং গীতিনাট্যতে ব্যবহৃত নড়াচড়ার সাথে কসরতবাজির সম্পর্ক আছে।

প্রাচীন যুগে আজ থেকে ৪ হাজার বছর আগে চীনদেশে শিয়া রাজবংশের আমলে কসরতবাজির প্রচলন ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম থেকে ৩য় শতকে চীনে এর জনপ্রিয়তা শিখরে পৌঁছে। চীনের সম্রাটরা কসরতবাজির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

আধুনিক যুগে ১৯শ শতকের মাঝামাঝি পাশ্চাত্যে কসরতবাজির জনপ্রিয়তার পুনর্জন্ম হয়। ২০শ শতকে ভ্রাম্যমাণ তাঁবুর রঙ্গালয়গুলিতে এগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

পেশাদার কুস্তি

মার্কিন ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেইনমেন্ট প্রতিষ্ঠানের আয়োজিত একটি দলগত পেশাদার কুস্তি লড়াই।

পেশাদার কুস্তি এক ধরনের পরিবেশন কলা যাতে পূর্বলিখিত চিত্রনাট্যের উপর ভিত্তি করে পাতানো বা মেকি কুস্তি লড়াই পরিবেশন করা হয়, যে লড়াইয়ের গতিপথ ও ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে। কুস্তিবিদরা মূলত এক ধরনের অভিনেতা যারা সুপ্রতিষ্ঠিত চরিত্রে অভিনয় করেন। পেশাদার কুস্তি লড়াইগুলি ধ্রুপদী গ্রিক ও ব্রিটিশ "ক্যাচ" (সব ধরনের দেহ আঁকড়ানোর কৌশল যেখানে অনুমোদিত) কুস্তির উপর ভিত্তি করে কাজ করে; তবে এগুলির সাথে ঘুষি-লাথি, কসরতবাজি, শক্তি প্রদর্শক কাজ, দ্রুতগতির মল্লক্রীড়াবাজি এবং কদাচিৎ তাৎক্ষণিক-উদ্ভাবিত হাতিয়ারের ব্যবহার হতে পারে। পেশাদার কুস্তিতে মুক্তহস্তে অতিনাটকীয়তা প্রয়োগ করা হয়। প্রকৃত কুস্তিগির বা মুষ্টিযোদ্ধাদের মতো পেশাদার কুস্তিগির চরিত্রগুলি আত্মগরিমা ও অতিরঞ্জিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকে। তাদের প্রায়শই দৃষ্টি আকর্ষণকারী কোনও বৈশিষ্ট্য বা ভঙ্গী বা দর্শন থাকে (গিমিক), এবং তাদের আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কগুলিতে বহু টানাপোড়েন থাকে। কুস্তি লড়াইয়ের পাশাপাশি এই চরিত্রগুলিও নাটকের মতো লেখা হয়ে থাকে। সাধারণত মুষ্টিযুদ্ধের ঘেরের মতো পেশাদার কুস্তির লড়াইগুলিও একটি উত্থিত মঞ্চের উপরে একটি ঘেরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। টেলিভিশনে প্রদর্শিত পেশাদার কুস্তি অনুষ্ঠানগুলিতে বহুসংখ্যক পর্দার আড়ালের দৃশ্যও ধারণ করা হয়, যেগুলি মঞ্চের লড়াইগুলির সম্পূরক নেপথ্য কাহিনী হিসেবে কাজ করে।

পেশাদার কুস্তি ১৯শ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে একটি প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রীড়া হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ১৯২০-এর দশকে কুস্তিগিররা শারীরিক চাপ কমাতে, কুস্তি লড়াইয়ের সময় কমাতে ও অধিকতর বিনোদন প্রদান করতে এগুলিকে পাতানো লড়াইয়ে পরিণত করতে শুরু করে। ফলে কুস্তিগিররা আরও বেশি ঘনঘন করে ও বেশি সংখ্যক দর্শকের সামনে কুস্তি পরিবেশন করতে শুরু করে। ১৯৩০-এর দশক পর্যন্তও সত্যিকারের কুস্তির লড়াই অনুষ্ঠিত হত। এই ব্যবসায়িক প্রতিমানটি (মডেল) খুবই সফল হয় এবং অন্যান্য দেশেও এটির অনুকরণ করা শুরু হয়; বিশেষ করে মেক্সিকো ও জাপানে। ঐতিহাসিকভাবে পেশাদার কুস্তিগিররা শুরুতে শৌখিন কুস্তি বা ক্যাচ কুস্তির সাথে সম্পৃক্ত থাকত। তবে বর্তমানে যেকোনও ক্রীড়া থেকেই পেশাদার কুস্তিগিরদের আগমন হতে পারে। তবে আজও অনেক পেশাদার কুস্তিগির পেশাদার কর্মজীবন শুরু করার আগে শৌখিন কুস্তিতে অংশ নেওয়াকে এক ধরনের আবশ্যকীয়তা হিসেবে গণ্য করে থাকেন।

জাদু

মার্কিন জাদুকর ডেভিড কপারফিল্ড (১৯৭৭)

জাদু এক ধরনের পরিবেশন কলা যাতে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কোনও কাজ সম্ভব করার বিভ্রম সৃষ্টি করে দর্শকদের বিনোদন প্রদান করা হয়। একজন জাদু পরিবেশন শিল্পী মনোস্তত্ব, হাতের দক্ষতা এবং যন্ত্রের সহায়তা নিয়ে উদ্দীষ্ট বিভ্রমটি সৃষ্টি করেন। তারা বস্তু, প্রাণী বা ব্যক্তিকে অদৃশ্য করে দেওয়া, মনের কথা পড়া, মাটি থেকে উঠে গিয়ে শূন্যে ভাসা, ইত্যাদি অসম্ভব কাজগুলি করার বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারেন। তবে বর্তমানে বেশিরভাগ জাদুর খেলাই হাতের মারপ্যাঁচ ধরনের, যেখানে কার্ড, পয়সা দ্রুত ও গোপনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা হয়। অনেক জাদুর খেলার রহস্যই বিভিন্ন বইতে লেখা থাকে যা সবাই পড়ে নিতে পারে। তবে জাদুর খেলা আয়ত্ত করতে বহু সপ্তাহ এমনকি বহু মাস লেগে যেতে পারে। অনেক জাদুশিল্পী তাদের জাদুর খেলার রহস্যগুলি যত্নের সাথে গোপন করে রাখেন।

প্রাচীনকালে বহু হাজার বছর ধরে অনেক মানুষ ভাবতেন যে জাদুকরদের হয়ত আসলেই বিশেষ ক্ষমতা আছে। তাদের কাজগুলিকে "জাদুটোনা" বলা হত। তারা বিশ্বাস করত জাদুকরেরা অন্য ব্যক্তি ও বৃষ্টি ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মহিলা জাদুকরদেরকে ডাকিনী বা ডাইনি বলা হত। পাশ্চাত্যে মধ্যযুগে এসে এক ধরনের পরিবেশন কলা হিসেবে জাদু প্রতিষ্ঠালাভ করে। সেসময় জাদুশিল্পীরা বিভিন্ন মেলায় ও অভিজাতদের গৃহে গিয়ে পরিবেশন করত। ১৯শ-২০শ শতকে এসে জাদুশিল্পীরা মঞ্চে সাধারণ দর্শকদের জন্য একাধিক জাদুর খেলা সংবলিত অনুষ্ঠান পরিবেশন করা শুরু করেন; এদের মধ্যে জঁ-ওজেন, রবার্ট হুডিনি, হ্যারি হুডিনি ও হ্যারি ব্ল্যাকস্টোনের নাম উল্লেখ্য। হ্যারি হুডিনি হাতকড়া কিংবা তালা আঁটা পোশাক (স্ট্রেইটজ্যাকেট) থেকে বের হয়ে আসার অসাধারণ জাদুর খেলা দেখাতেন। ২০শ শতকের শেষে এসে ডাগ হেনিং ও ডেভিড কপারফিল্ডের মতো শিল্পীরা টেলিভিশন মাধ্যমের জন্য বর্ণময় চোখধাঁধানো জাদুর অনুষ্ঠান পরিবেশন করতেন। অন্যদিকে পেন ও টেলার নামক উত্তরাধুনিক জাদুকরেরা অপেক্ষাকৃত নিরব ধরনের জাদু পরিবেশন করেন যাতে পরিহাস ও বিভ্রমের উপরে বেশি জোর দেওয়া হয়।

মায়াস্বর

ভারতীয় মায়াস্বরশিল্পী সাতি আচাথ ও তাঁর পুতুল

মায়াস্বর একধরনের পরিবেশন কলা যাতে শিল্পী তাঁর কণ্ঠজাত ধ্বনি এমনভাবে নিক্ষেপ করতে পারেন, যাতে শ্রোতার মনে হয় অন্য কোনও উৎস থেকে ধ্বনি উৎপন্ন হচ্ছে। এই ছলনামূলক কাজে প্রায়শই মায়াস্বর শিল্পীর হাতে একটি নকল মূর্তি বা পুতুল থাকে। মায়াস্বর শিল্পী হাত দিয়ে পুতুলের মুখ নাড়ান এবং নিজের মুখ ও ঠোঁট প্রায় বন্ধ রেখে ও না নড়িয়ে এমনভাবে কথা বলেন যেন মনে হয় পুতুলের মুখ থেকেই কথা বের হচ্ছে। সাধারণত মায়াস্বরটি শিল্পীর নিজের কণ্ঠ থেকে তীক্ষ্ম হয়ে থাকে। একজন মায়াস্বর শিল্পী কথা বলার সময় ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়েন, শ্বাসরন্ধ্র ও গলার পেশী সংকুচিত করে ধ্বনিগুণ পরিবর্তন করেন, মুখ খুবই অল্প করে খোলা রাখেন, এবং জিহবাকে পেছনে নিয়ে শুধু জিহ্বার ডগা নড়িয়ে শব্দ করেন। স্বরতন্ত্রীর উপর চাপ দিয়ে ধ্বনিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। স্বরতন্ত্রীর উপরে যত চাপ পড়বে, দূরত্বের বিভ্রমও তত বেশি হবে। এসব করার সময় মায়াস্বর শিল্পী এক ধরনের নিষ্ক্রিয় মুখাভিব্যক্তি ধরে রাখেন যাতে শ্রোতা দর্শকের আগ্রহ বিভ্রম সৃষ্টিকারী উৎসের উপরে নিবদ্ধ থাকে। এভাবে শিল্পী একবার নিজের স্বরে, আরেকবার পুতুলের মুখ দিয়ে মায়াস্বরে কথা বলে কথোপকথন চালান।

মায়াস্বর অত্যন্ত প্রাচীন একটি কলা। প্রাচীন গ্রিসের অ্যাথেন্স নগরীর এউরিক্লেস একজন মায়াস্বর শিল্পী ছিলেন। কিছু কিছু জাতি যেমন মাওরি, জুলু ও এস্কিমো জাতির লোকেরা অনেকেই দক্ষ মায়াস্বর শিল্পী। বিবিধ বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান যেমন পুতুল নাচের অনুষ্ঠান বা "ভডভিল" ঘরানার অনুষ্ঠানগুলিতে মায়াস্বর শিল্পীরা পরিবেশন করে থাকেন। ২০শ শতকের মাঝামাঝি তারা খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। পাশ্চাত্যে মার্কিন এডগার বার্গেন এবং ফরাসি রোবের লামুরে দুইজন উল্লেখযোগ্য মায়াস্বর শিল্পী ছিলেন।

বাগ্মিতা

মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৬৩ সালের আগস্ট মাসে তাঁর বিখ্যাত "আই হ্যাভ আ ড্রিম" ("আমার একটি স্বপ্ন") বাক্যসংবলিত বক্তৃতাটি প্রদান করেন।

বাগ্মিতা বলতে কোনও অবস্থানের সপক্ষে বা বিপক্ষে শ্রোতাদেরকে প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে জনসমক্ষে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা প্রদানের পরিবেশন কলাকে বোঝানো হয়। একজন বাগ্মী ব্যক্তিকে "বক্তা" বলা হয়, আর তিনি যে কথামালা পরিবেশন করেন, তাকে বক্তৃতা বলে। বাগ্মিতায় বক্তা ও শ্রোতাবৃন্দের সম্পর্ক ও তাদের প্রতিক্রিয়া মুখ্য হলেও কখনও কখনও এর সুদূরপ্রসারী ঐতিহাসিক গুরুত্বও থাকতে পারে। একজন বাগ্মী বা বক্তা কোনও দেশ, সমাজ বা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের কণ্ঠস্বরে পরিণত হতে পারেন। বক্তা তাঁর বক্তৃতাতে নির্দিষ্ট স্থান-কাল ও অন্যান্য ঐতিহাসিক শর্তাবলির প্রেক্ষাপটে একদল শ্রোতার উদ্দেশ্যে তাঁর কণ্ঠস্বর, উচ্চারিত শব্দের স্পষ্টতা ও জোর , হাত ও দেহের নড়াচড়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে এক বা একাধিক বার্তা জ্ঞাপন করেন, যার কোনও তাৎক্ষণিক ফলাফল থাকতেও পারে বা না-ও থাকতে পারে। একজন বক্তা বক্তৃতা প্রদানের সময় আত্মবিশ্বাস, অকৃত্রিম চারিত্রিক অখণ্ডতা ও প্রেরণাসঞ্চারী শক্তি প্রদর্শন করে শ্রোতাদের আস্থা অর্জন করেন। তিনি বক্তৃতার শুরুতে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, সৃষ্টিশীলতা প্রদর্শন করে ও স্মরণীয় বাচনভঙ্গি দিয়ে বিভিন্ন ধারণা, যুক্তি ও তথ্য উপস্থাপন করেন, তাদের আগ্রহ ধরে রাখেন, তাদেরকে তাঁর সিদ্ধান্ত বা সমাধানের সাথে একমত হতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সবশেষে শ্রোতাদের কাছ থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবার ব্যাপারে অঙ্গীকার আদায় করেন।

বাগ্মিতার তাত্ত্বিক বুনিয়াদ বা ভিত্তি হল অলংকারশাস্ত্র (Rhetoric), যা দিয়ে কোন্‌ শব্দ কীভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে, তার শিল্পকলাকে বোঝানো হয়। পদ্য বা কথাসাহিত্যে ভাষার সৌন্দর্য ও সুখপ্রদানের মতো ব্যাপারগুলি প্রধান; এর বিপরীতে বাগ্মিতাতে ভাষাকে মূলত ব্যবহারিক ও নৈমিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করা হয়। বাগ্মিতাতে চিরন্তন বা স্থায়ী কিছু সৃষ্টি করার অভিলাষ থাকে না। একজন বক্তার উদ্দেশ্য ও কৌশল প্রধানত প্ররোচণামূলক, তথ্য প্রদান বা বিনোদন প্রদানের সাথে এর সম্পর্ক কম। বক্তা তার বক্তৃতার মাধমে মানব আচরণ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন কিংবা কোনও দৃঢ়বিশ্বাস বা মনোভাবকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। তিনি শ্রোতাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে নিজ অবস্থানে নিয়ে আসতে চেষ্টা করেন। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে তিনি যুক্তি, ব্যাক্যালংকার কৌশল, আরোহী বা অবরোহী যুক্তিপ্রবাহ, তথ্যপ্রমাণ ও শ্রোতার অনুভূতিতে নাড়া দেওয়ার মতো ব্যাপারগুলির সাহায্য নেন। এছাড়া তিনি ব্যাখ্যাকরণের মাধ্যমে তিনি নিজের অবস্থান পরিষ্কার ও শক্তিশালী করেন এবং নিজের বা অন্যের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টান্তমূলক ঘটনার সাহায্যে শ্রোতার প্রতিক্রিয়া বলবত্তর করেন। একজন বক্তার প্রথম শ্রেণীর যুক্তিবিদ হওয়া আবশ্যক নয়। তবে পরিষ্কার ও উন্নতমানের চিন্তা করার ক্ষমতাবলে তিনি পরীক্ষমূলক প্রতিজ্ঞা (ভিত্তিবাক্য) ও সিদ্ধান্তের কারণ ও ফলাফলগুলি বিশ্লেষণ করতে পারেন এবং সাদৃশ্য, সাধারণীকরণ, পূর্বানুমান, আরোহী-অবরোহী যুক্তিবিন্যাস এবং অন্যান্য ধরনের উপপত্তি ব্যবহার করতে পারেন। দক্ষ বিতার্কিকেরা যুক্তির উপরে বেশি নির্ভর করে থাকেন, কিন্তু তারা সবসময় চিত্তাকর্ষক বক্তা হন না, কেননা উচ্চমানের বাগ্মিতাতে মানুষের প্রবৃত্তি, প্রেরণা, অনুভূতি ও অভ্যাসের মতো ব্যাপারগুলির প্রতিও আবেদন রাখা হয়। শক্তিশালী আবেগপূর্ণ বাক্যগঠনশৈলী ও বাচনভঙ্গি একজন বক্তাকে শ্রেষ্ঠত্বের সন্ধান দিতে পারে। হৃদয়ছোঁয়া মর্মস্পর্শী আবেদনের অনুপস্থিতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধর্মাবলির আধিপত্য যেমন একটি বক্তৃতাকে বিফল করে দিতে পারে, ঠিক একইভাবে যুক্তিকে ছাপিয়ে আবেগ-অনুভূতিকে বেশি প্রাধান্য দিলেও একই পরিণাম হতে পারে। একজন আদর্শ বক্তা তাই বস্তুনিষ্ঠ বা নিরাসক্তভাবে বক্তব্য পেশ না করে শ্রোতার প্রতি ব্যক্তিগত আবেদন-নিবেদন রাখেন ও নৈতিক শক্তির পরিচয় দেন। তিনি তাঁর অবস্থানের সপক্ষতা করার সময় ব্যক্তিগত অঙ্গীকার প্রকাশ করে তাঁর যুক্তিকে শক্তিপ্রদান করেন। প্রাচীন রোমান ইতিহাসবিদ কিকেরো-র মতে একজন পূর্ণাঙ্গ বক্তা হলেন সেই বিরল ব্যক্তি যার মাঝে একই সাথে যুক্তিবিদের তীক্ষ্মতা, দার্শনিকের প্রজ্ঞা, কবির ভাষা, আইনবিদের স্মৃতি, বিয়োগান্ত নাট্যকারের কণ্ঠস্বর, সেরা অভিনেতাদের অঙ্গভঙ্গি---এ সবকিছুর মিশ্রণ ঘটেছে।

বাগ্মিতাকে ঐতিহ্যগতভাবে আইনি, রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিক এই তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। গ্রিক দার্শনিক আরিস্তোতলের মতানুযায়ী বাগ্মিতাকে আদালতি, পরামর্শমূলক বা মন্ত্রণামূলক এবং অভিব্যক্তিমূলক (epideictic) এই তিনভাগে ভাগ করা যায়। মধ্যযুগে ধর্মীয় বক্তৃতার উত্থান ঘটে, যার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ধর্মান্তরিত বা ধর্মনিষ্ঠ করা। ১৮শ-১৯শ শতকে এসে সংসদ ও আইনসভাগুলিতে রাজনৈতিক বক্তৃতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যেগুলির উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের (যেমন কোনও অধিকার সুরক্ষা করা, যুদ্ধে যাওয়া, ইত্যাদি) পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত প্রদান করা। ২০শ-২১শ শতকে এসে বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, সংবাদপত্র, ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম, ইত্যাদি গণযোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে একটি বক্তৃতার কথিত ও লিখিত রূপ অল্প সময়ে লক্ষ কোটি শ্রোতা ও মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হয়।

বাগ্মিতা যখন কুউদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার অংশ হিসেবে গণ্য করা হতে পারে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আডলফ হিটলার তাঁর বাগ্মিতাকে ব্যবহার করে জার্মানিতে নাৎসিবাদের ভিত্তি শক্ত করেছিলেন।

নতুন মাধ্যম কলা

অসদ বাস্তবতা কলা

জার্মানির ডর্টমুন্ড শহরের শিল্পকলা জাদুঘরে ২০১৮ সালে দর্শকেরা হেডসেট ও স্মার্টফোনের অ্যাপের সাহায্যে একটি অসদ ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যের সাথে আন্তঃক্রিয়ায় লিপ্ত আছেন। এটি হল জার্মান চিত্রশিল্পী বেনো এলকেনের একটি অসমাপ্ত ভাস্কর্য, যাকে অসদ বাস্তবতা প্রযুক্তির মাধ্যমে পুনর্নিমাণ করা হয়েছে

অসদ বাস্তবতা কলা বলতে এমন এক ধরনের শিল্পকলাকে বোঝায় যেখানে পর্যবেক্ষক কোনও অসদ বাস্তবতা প্রযুক্তির সাথে আন্তঃক্রিয়াতলে অবস্থান করে দৃশ্যমান, শ্রাব্য ও স্পর্শনীয় শিল্পকর্মে নিমজ্জিত হন ও সেটির সাথে কিছু বিশেষ কারিগরি উপকরণের সাহায্যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তঃক্রিয়ায় লিপ্ত হন, এমনকি সেটিকে পুনর্বিন্যস্ত করতে পারেন। অন্য ভাষায় অসদ বাস্তবতা কলা হল শিল্পকলার প্রযুক্তিভিত্তিক অসদায়ন। অসদ বাস্তবতা কলাতে শৈল্পিক অভিব্যক্তির সাথে সর্বাধুনিক বৈদ্যুতিন (ইলেকট্রনীয়), পরিগণন (কম্পিউটিং) ও আন্তর্জাল (ইন্টারনেট) প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটেছে। এটি মূলত বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যে কারিগরি কলার আবির্ভাব ঘটে, তারই একটি অধিকতর পরিশীলিত রূপ। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে কিছু শিল্পী আন্তর্জাল (ইন্টারনেট), দ্বি-আঙ্কিক পরিগণক যন্ত্র (ডিজিটাল কম্পিউটার) ও ফাঁপাচিত্রণ (হলোগ্রাফি) কৌশলগুলি আয়ত্ত করলে এই অদস বাস্তবতা কলার জন্ম হয়। ত্রিমাত্রিক পরিগণকীয় চিত্রণ, আন্তঃক্রিয়াশীল শ্রাব্য বিষয়বস্তু, তাৎক্ষণিক নড়াচড়া অনুসরণ, ইত্যাদি এইসব শিল্পকর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য। ১৯৯৫ সালে ফরাসি শিল্পী মোরিস বেনাইউন প্যারিসের আধুনিক শিল্পকলা জাদুঘর ল্য সঁত্র পোঁপিদুতে ল্য ত্যুনেল সু লাতলঁতিক ("আটলান্টিকের নিচে সুড়ঙ্গ") নামের যে অসদ বাস্তবতাভিত্তিক স্থাপনাটি প্রদর্শন করেন, সেটিই সম্ভবত সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ অসদ বাস্তবতা শিল্পকর্ম ছিল। এটিতে দর্শকেরা অসদ বাস্তবতা নিমজ্জিত হয়ে প্রায় ছয় দিন ধরে আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে একটি অসদ বাস্তব সুড়ঙ্গ খুঁড়ে অপর প্রান্তে কানাডার মোঁরেয়াল (মন্ট্রিয়ল) নগরীতে অবস্থিত আধুনিক শিল্পকলা জাদুঘরে পৌঁছান। তবে তারও আগে ১৯৯১ সালে বার্লিন ও জেনেভার মধ্য সংযোগ স্থাপনকারী মোনিকা ফ্লাইশমান ও ভোলফগাং ষ্ট্রাউসের হোম অভ দ্য ব্রেইন সম্ভবত প্রথম এরকম শিল্পকর্মের একটি ছিল, যেখানে বিশেষ চশমা ও দস্তানা পরিধান করে দর্শক অসদ বাস্তবতায় নিমজ্জিত হয়ে বার্লিনের নবনির্মিত জাতীয় চিত্রশালার একটি কক্ষে বিচরণ করতে পারতেন। ২১শ শতকে এসে অসদ বাস্তবতা শিরোস্ত্রাণ (ভার্চুয়াল রিয়ালিটি হেডসেট) ও ভিডিও খেলার নিয়ন্ত্রক (কন্ট্রোলার) দর্শককে আরও বেশি আন্তঃক্রিয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে অত্যন্ত শক্তিশালী বুদ্ধিমান মুঠোফোনের (স্মার্টফোন) বদৌলতে দর্শক ঘরে বসেই এগুলির স্বাদ নিতে পারেন। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে ঐতিহ্যবাহী জাদুঘর ও শিল্প প্রদর্শনীঘরগুলি স্থানকালের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে অসদ বাস্তব প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারে, ফলে শিল্পের গণতন্ত্রায়নের অপার সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। যেমন বিশ্বের প্রায় ২ হাজার জাদুঘরে গুগল আর্টস অ্যান্ড কালচার প্রকল্পের সাহায্যে "ভার্চুয়াল রিয়ালিটি টুর" (অসদ বাস্তবতাভিত্তিক পরিদর্শন) প্রস্তাব করছে।

অসদ বাস্তবতা কলাতে প্রযুক্তির অধিকতর মানবিকীকরণ ঘটেছে, দর্শক বা অংশগ্রহণকারীর আন্তঃক্রিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রকৃত বাস্তবতা ও অসদ বাস্তবতা মধ্যকার সীমানা নিয়ে দার্শনিক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, এবং এটিতে একটি নয়, বরং বহুসংখ্যক ইন্দ্রিয়ের প্রয়োগ ঘটেছে। অসদ বাস্তবতা শিল্পীরা একই সাথে প্রযুক্তি ও সৌন্দর্যের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ এবং এভাবে তাঁরা সর্বদা অভিনব নতুন নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক আন্তঃক্রিয়াতল ও সম্ভাব্য আন্তঃক্রিয়া নকশা করেন। তাঁদের সৃষ্টিকর্মে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমাজ, এমনকি মানুষের মৌলিক চাহিদা ও তাড়না সংক্রান্ত শিল্প-বহির্ভূত লক্ষ্যগুলি লক্ষণীয়। অসদ বাস্তব শিল্পকর্মগুলির মধ্যে আছে দ্বি-আঙ্কিক বা ডিজিটাল কিন্তু বাস্তবে রূপায়িত কর্ম, বহু-বিষয়বস্তু কিন্তু পরিগণক/আন্তর্জাল থেকে বিচ্ছিন্ন কর্ম, আন্তঃক্রিয়াশীল দ্বি-আঙ্কিক সংস্থাপনা, বহু-বিষয়বস্তু আন্তর্জাল কর্ম। মার্কিন শিল্পকলার ইতিহাসবিদ ফ্র্যাংক পপারের মতে অসদ বাস্তবতা কলা বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তি যুগে মানবতাবাদী মূল্যবোধ নিয়ে চিন্তাভাবনার একটি নতুন প্রতিমান প্রদান করেছে, যা তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য খুবই অনুপ্রেরণাদায়ী।

বহুমাধ্যম নিমগ্ন কলা

ফ্রান্সের লে-বো-দ্য প্রোভঁস শহরে আয়োজিত একটি বহুমাধ্যম নিমগ্ন কলা প্রদর্শনীতে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ফান গখের তারকাখচিত আকাশ (De sterrennacht "ডে স্টেরেননাখট") চিত্রকর্মটির একটি পরিবর্তিত ডিজিটাল রূপ বিরাট মাপে প্রদর্শিত হচ্ছে।

২১শ শতকের দ্বিতীয় দশকে কিছু কিছু জাদুঘরে এক নতুন ধরনের শিল্পকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করা শুরু হয়, যাকে বহুমাধ্যম নিমগ্ন কলা (Multimedia immersive art) বলে। এতে মূল চিত্রকর্ম বা শিল্পকর্মের পরিবর্তে সেগুলির পরিবর্তিত ত্রিমাত্রিক স্থির ও চলমান ডিজিটাল চিত্র সংস্করণ তৈরি করে বিরাট মাপে সেগুলিকে বিশালাকার প্রদর্শনীকক্ষের দেয়ালে, মেঝেতে ও ছাদে আলোক ও লেজার প্রক্ষেপক যন্ত্রের (প্রজেক্টর) সাহায্যে প্রক্ষিপ্ত করে, আবহধ্বনি যোগ করে ও অভ্যন্তরীণ স্থাপত্যের মূলনীতি কাজে লাগিয়ে দর্শককে ৩৬০ ডিগ্রি কোণে শিল্পকর্মগুলির মধ্যে নিমগ্ন বা নিমজ্জিত করা হয়। ভিডিও মানচিত্রণ (ভিডিও ম্যাপিং), বর্ধিত বাস্তবতা (অগমেন্টেড রিয়্যালিটি), অসদ বাস্তবতা (ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ধ্বনি প্রযুক্তি, আলোক প্রক্ষেপণ প্রযুক্তি দিয়ে প্রযুক্তিদক্ষ শিল্পীরা এমন একটি পরিবেষ্টনকারী অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করেন, যাতে দর্শনার্থীদের মনে হয় তারা শিল্পকর্মের অংশে পরিণত হয়েছেন। এই কলাটি বহুমাধ্যম তথা বহু-ইন্দ্রিয়ভিত্তিক; এখানে দৃষ্টি, শ্রুতি, স্পর্শ এমনকি কদাচিৎ ঘ্রাণের ইন্দ্রিয়েরও ব্যবহার হতে পারে। প্রথম দিকে লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, কারাভাজ্জো, ক্লোদ মোনে, ভিনসেন্ট ফান গখ, গুস্টাভ ক্লিমট, র‍্যনে মাগ্রিত, সালভাদোর দালি, সেজান, রেমব্রান্ট, প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম নিয়ে এগুলি আয়োজন করা হয়। পরবর্তীতে কোনও জাদুঘরের সেরা সংগ্রহ পরিবেশন (যেমন উফফিৎসি চিত্রশালা), কোনও নগরীর সেরা দিকগুলি তুলে ধরা (যেমন ২০১৭ সালের ইতালির বোলোনিয়া অভিজ্ঞতা), এমনকি ঐতিহাসিক কাহিনীর পুনর্বর্ণন (যেমন গাল্লিপোলির স্বর্ণযুগ), ইত্যাদিও এই ধরনের প্রদর্শনীর উপজীব্য হয়ে ওঠে। এই নতুন ধরনের কলা পুরাতন বস্তুবাদী মূর্ত কলার এমন একটি নতুন বিমূর্ত রূপ সৃষ্টি করেছে, যা বর্তমানে যোগাযোগমাধ্যমের সংকেতবিজ্ঞান ও নন্দনতত্ত্বে অধীত হবার যোগ্য। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের লাতলিয়ে দে ল্যুমিয়ের (L'Atelier des Lumières) এবং জাপানের রাজধানী টোকিও-র টিমল্যাব বর্ডারলেস জাদুঘর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি শহরভিত্তিক সুপারব্লু, ইত্যাদি এই ধরনের কলা পরিবেশনকারী অগ্রপথিক কিছু সংগঠন।

ধ্বনি কলা

কানাডীয় ধ্বনিশিল্পী জ্যানেট কার্ডিফের ধ্বনিশিল্পকর্ম ফর্টি পার্ট মোটেট ("চল্লিশ পর্বের পবিত্র প্রার্থনাসঙ্গীত"), ২০০১, আরোস আরহুস শিল্পকলা জাদুঘর, ডেনমার্ক

ধ্বনি কলা বা শব্দ কলা বা শ্রুত কলা বলতে সমসাময়িক কলার একটি শাখাকে বোঝায়, যেখানে ধ্বনি বা শব্দকে সৃষ্টিশীল অভিব্যক্তির মাধ্যম ও বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটিকে ধ্বনি ভাস্কর্য, ধ্বনি কাব্য, ইত্যাদি নামেও ডাকা হতে পারে। একটি ভৌত ভাস্কর্যের মতো ধ্বনিও কোনও স্থান দখল করে রাখে, কিন্তু সেটি আমাদের দেহের ভেতর দিয়েও অনুরণিত হয়। ফলে এভাবে ধ্বনির মধ্যে নিমজ্জিত বা নিমগ্ন দেহে ও মনে যেসব সংবেদন ও ভাবের সৃষ্টি হয়, সেটি চোখের মাধ্যমে চিত্র দর্শনের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত অনুভূতির চেয়ে ভিন্ন। এভাবে অদৃশ্য ধ্বনির সুনিপুণ শৈল্পিক ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রোতার মনে স্মৃতি, অভিলাষ, বিষাদ, আকুলতা, অতীতবিধুরতা, পলায়নী ভাব, ইত্যাদি গভীর অনুভূতি ও আবেগের জন্ম হতে পারে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে (জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স) পরবাস্তবতাবাদী ও দাদাবাদী শিল্পকলা আন্দোলনের সাথে সাথে এটির বিকাশ ঘটে। মার্সেল দুশঁ-র আ ব্র্যুই স্যক্রে (১৯১৬, "গোপন ধ্বনি") নামের শিল্পকর্মটিকে ধ্বনিকলার অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়, যাতে দুইটি পিতলের পাতের মধ্যে আটকে থাকা একটি পাকানো সুতার গোলার মধ্যে একটি গোপন বস্তু স্থাপিত ছিল। যখন শিল্পকর্মটিকে নাড়ানো হবে, তখন সেই বস্তুটি একটি ধ্বনি উৎপাদন করে, যা থেকে শ্রোতাকে অনুমান করতে হবে সেটি কী। এভাবে চিন্তা ও অভিজ্ঞতা সৃষ্টিকারী মাধ্যম হিসেবে ধ্বনির সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। ধ্বনি কলাতে যা কিছু ধ্বনি সৃষ্টি করে, তা-ই শিল্পের অংশ হতে পারে, যেমন বৃষ্টির টুপটাপ, নিরবতা, উচ্চারিত কবিতা, গান, ইত্যাদি। ইদানিং আন্তর্জালে স্বতঃস্ফূর্ত ইন্দ্রিয়জাত চরম প্রতিক্রিয়া (অটোনমাস সেনসরি মেরিডিয়ান রেসপন্স বা এএসএমআর) নামের যে শিহরণমূলক অনুভূতি প্রদানকারী পরিবেশন কর্মের বিস্তার ঘটেছে, সেটিকেও এক ধরনের ধ্বনি কলা হিসেবে গণ্য করা যায়, কেননা এতে ফিসফিস করে কথা বলা, ফুঁ দেয়ার শব্দ, বস্তু ঘষা বা হালকা আঘাত করার শব্দ, ইত্যাদি বিভিন্ন দৈনন্দিন শব্দগুলিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে শ্রোতা মস্তিষ্কে ও মেরুদণ্ডে এক ধরনের শিরশিরে বা শিহরণমূলক অনুভূতি অনুভব করে।

আন্তঃক্রিয়াশীল কলা

বৈদ্যুতিন (ইলেকট্রনীয়) কলা

দ্বি-আঙ্কিক (ডিজিটাল) শিল্পকলা

আন্তর্জাল (ইন্টারনেট) শিল্পকলা

বহুমাধ্যম (মাল্টিমিডিয়া) শিল্পকলা

পরিগণকীয় চিত্রলিখন

পরিগণকীয় সচলচিত্র নির্মাণ

ভিডিও খেলা

বিবিধ শিল্পকলা

জঞ্জাল কলা

ব্রিটিশ শিল্পী নিক জেনট্রি-র সৃষ্ট ডিজিটাল মন্টাজ নাম্বার টু (২০১২), এই চিত্রটি পরিত্যক্ত ফ্লপি ডিস্ক ব্যবহার করে সৃষ্টি করা হয়েছে।

পৌর বা শহুরে জীবনের প্রাত্যহিক বিভিন্ন বাতিল, ফেলে দেওয়া জঞ্জাল বা আবর্জনাকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে শিল্পকর্ম তৈরি করাকে জঞ্জাল কলা (Junk art) বলে। ২০শ শতকের শুরু থেকেই আধুনিকতাবাদী শিল্পীরা চারুকলায় ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী উপাদানসমূহের ব্যবহারের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ শুরু করেন এবং তুচ্ছ, মূল্যহীন পদার্থ দিয়েও যে শিল্পকর্ম সৃষ্টি সম্ভব তা প্রদর্শনের চেষ্টা করেন। পাবলো পিকাসোর ঘনকবাদী সাঁটচিত্র, মার্সেল দ্যুশঁ-র পূর্বপ্রস্তুত কর্মগুলি বা কুর্ট শভিটারসের শিল্পকর্মগুলিকে এইরূপ জঞ্জাল কলার প্রথম দিককার উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, তবে এগুলিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জঞ্জাল কলা হিসেবে ধরা হয় না। ১৯৫০-এর দশকে এসে প্রথম একটি শিল্পকলা আন্দোলন হিসেবে জঞ্জালকলা আন্দোলনের উদ্ভব হয়, যা বিশেষ করে টেক্সাস-ভিত্তিক মার্কিন চিত্রকর রবার্ট রাউশেনবার্গের চিত্রকর্মগুলিতে ধরা পড়ে; তিনি ক্যানভাসের উপরে পরিত্যক্ত ছেঁড়া কাপড় ও অন্যান্য আবর্জনা স্থাপন করে সংযুত চিত্রকর্মগুলি সৃষ্টি করেন। ব্রিটিশ শিল্পসমালোচক লরেন্স অ্যালোওয়ে প্রথম ১৯৬১ সালে এগুলির নাম দেন "জঞ্জাল কলা" (Junk art)। তিনি ধাতুর টুকরা, ভাঙা যন্ত্রাংশ, ছেঁড়া কাপড়, কাঠের টুকরা, ফেলে দেওয়া কাগজ ও অন্যান্য পরিত্যক্ত উপাদান ব্যবহার করে নির্মিত ত্রিমাত্রিক কলাগুলির জন্য এই নামটি প্রয়োগ করেন। দাদাবাদী শিল্পকলা, ইতালির আলবের্তো বুররি ও পরবর্তীতে আর্তে পোবরা আন্দোলনের শিল্পকর্ম, স্পেনের আন্তোনি তাপিয়েসের শিল্পকর্ম ও ক্যালিফোর্নিয়ার ফাঙ্ক শিল্পকলা আন্দোলনের সাথে এটির সাদৃশ্য আছে।

জঞ্জাল কলাকে "আবিষ্কৃত কলা"-র (Found art) একটি প্রকারভেদ হিসেবে গণ্য করা হয়।

  • "The Art of Video Games"SI.edu। Smithsonian American Art Museum। সংগ্রহের তারিখ ৭ মার্চ ২০১৫ 
  • Barron, Christina (২৯ এপ্রিল ২০১২)। "Museum exhibit asks: Is it art if you push 'start'?"The Washington Post। ৪ জুন ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ 
  • "Conceptual art"Tate Glossary। সংগ্রহের তারিখ ৭ মার্চ ২০১৫ 
  • Feynman, Richard (১৯৮৫)। QED: The Strange Theory of Light and Matterবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। Princeton University Press। আইএসবিএন 978-0691024172 
  • "FY 2012 Arts in Media Guidelines"Endow.gov। National Endowment for the Arts। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ মার্চ ২০১৫ 
  • Gibson, Ellie (২৪ জানুয়ারি ২০০৬)। "Games aren't art, says Kojima"Eurogamer। Gamer Network। সংগ্রহের তারিখ ৭ মার্চ ২০১৫ 
  • Kennicott, Philip (১৮ মার্চ ২০১২)। "The Art of Video Games"The Washington Post। ৪ জুন ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ 

বহিসংযোগ


Новое сообщение