Продолжая использовать сайт, вы даете свое согласие на работу с этими файлами.
অতিস্থূলতা
অতিস্থূলতা | |
---|---|
বিশেষত্ব | অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিবিজ্ঞান |
মেদাধিক্য(ইংরেজি: Obesity, ওবিসিটি) হলো শরীরের এক বিশেষ অবস্থা, এই অবস্থায় শরীরে অতিরিক্ত স্নেহ বা চর্বি জাতীয় পদার্থ জমা হয় এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে, ফলে আয়ু কমে যেতে পারে এবং একইসঙ্গে শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।বডি মাস ইনডেক্স (BMI) হলো শরীরের উচ্চতা ও ওজনের আনুপাতিক হার, যা দিয়ে বোঝা যায় যে কোনো ব্যক্তি মাত্রাধিক ওজন (pre-obese) বিশিষ্ট কিনা। যদি কারো বডি মাস ইনডেক্স (BMI) ২৫ kg/m2 থেকে ৩০ kg/m2মধ্যে থাকে তখন তাকে স্থূলকায় বা মোটা বলা যেতে পারে, আর যখন বডি মাস ইনডেক্স (BMI) ৩০ kg/m2 বেশি থাকে তখন তাকে অতি স্থূলকায় বা অতিরিক্ত মোটা বলা হয়।
স্থূলতা বৃদ্ধি পেলে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন রোগের সম্ভাবনা দেখা দেয়, বিশেষত হৃদরোগ, দ্বিতীয় পর্যায়ের ডায়াবেটিস বা মধুমেহ, শুয়ে থাকার সময় শ্বাসকষ্ট, কয়েক ধরনের ক্যান্সার এবং অস্টিওআর্থারাইটিস। অতিরিক্ত ক্যালোরিযুক্ত খাদ্যগ্রহণ, কায়িক শ্রমের অভাব, বংশ পরম্পরায় জিনগত বৈশিষ্ট্য থেকে প্রাপ্ত গুণাবলী, কিছু ক্ষেত্রে জিনের চরিত্রের পরিবর্তন, হরমোন গ্রন্থির গণ্ডগোল, ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদিকেই স্থূল বা মোটা হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী করা যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, অনেকে খুব কম পরিমাণে খাচ্ছেন অথচ ক্রমশ ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর জন্য ধীর বিপাক ক্রিয়া বা ধীরে হজম হওয়াকেই দায়ী করা যেতে পারে; শীর্ণ বা রোগা ব্যক্তিদের তুলনায় স্থূলকায় ব্যক্তিদের শরীরে বেশি শক্তি সঞ্চিত থাকায় তারা গড়ে বেশি পরিমাণ কর্মশক্তি ব্যয় করতে পারে।.
মাপ মতো খাবার খাওয়া (dieting) এবং শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রমই হলো এই স্থূলতা কমানোর প্রাথমিক চিকিৎসা। সীমিত খাদ্যগ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রমে কাজ না হলে এর পাশাপাশি স্থূলতা হ্রাসের ওষুধ খাওয়া যেতে পারে, এই ধরনের ওষুধ খাওয়ার ফলে ক্ষুধা বা খিদের পরিমাণ অনেকটাই কমে আসে বা স্নেহ বা চর্বি জাতীয় পদার্থের বিপাকের হার বাধা পায়। তুলনামূলকভাবে যারা বেশি মোটা বা স্থূল, তাদের ক্ষেত্রে শল্য চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে বা পাক-ব্যবস্থায় বেলুন ব্যবহার করে পাকস্থলীর আয়তন বা অন্ত্রের আয়তন কমিয়ে আনা যেতে পারে, এর ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি স্বল্প খাবারেই তৃপ্ত হতে পারে ও খাদ্য থেকে খাদ্যগুণ গ্রহণের ক্ষমতাও কমে আসে।
বর্তমানে গোটা বিশ্বে স্থূলতাই মৃত্যুর অন্যতম প্রতিষেধযোগ্য কারণ হিসাবে চিহ্নিত, প্রাপ্ত বয়স্ক ও শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা দিনের পর দিন বাড়ছে এবং একবিংশ শতাব্দীতে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এই সমস্যাক মারাত্মক আকার নিতে চলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বর্তমান যুগে পশ্চিমী দুনিয়ায় স্থূলতাকে কলঙ্ক হিসাবেই বিবেচনা করা হয়, অবশ্য অতীতে সম্পদ ও উর্বরতার প্রতীক হিসাবেই দেখা হতো স্থূলকায়দের, এখনও আফ্রিকা মহাদেশের কিছু অংশে এই ধারণা রয়ে গেছে।
শ্রেণীভুক্তকরণ
অতিস্থূলতা বা ওবেসিটি হলো এক শারীরিক অবস্থা; এক্ষেত্রে শরীরে অতিরিক্ত স্নেহ জাতীয় পদার্থের সঞ্চয় হয় এবং স্বাস্থ্যের ওপর তার ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে। বডি মাস ইনডেক্স (BMI)-ই এর সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং আরো মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখা গেছে, কোমর-নিতম্বের অণুপাত মেনেই এই চর্বি বা স্নেহ পদার্থ সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকে এবং এর ফলে হৃদ-ধমনীর রোগ দেখা দিতে পারে। বডি মাস ইনডেক্স (BMI) শরীরের স্নেহ পদার্থের শতকরা হার ও শরীরের মোট স্নেহ পদার্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
শিশুর বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী স্বাস্থ্যবান শিশুদের ওজনের তারতম্য ঘটে। শিশুকাল ও বয়ঃসন্ধিকালের স্থূলতা কখনোই প্রকৃত সংখ্যা্ দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না, এর সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবেই স্বাভাবিক গোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে, যেমন এক্ষেত্রে স্থূলতা মাপতে গেলে 95th percentile-এর তুলনায় বডি মাস ইনডেক্স (BMI)-র বেশি হতে পারে। Percentile সংক্রান্ত ডেটা ধরা হয় ১৯৬৩ থকে ১৯৯৪সালে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এবং সম্প্রতি ওজন বাড়লেও ঐ ডেটার তেমন বদল হয়নি বলেই মনে করা হয়।
বি এম আই (BMI) | শ্রেণীবিভাগ |
---|---|
< ১৮.৫ | আণ্ডারওয়েট বা কম ওজন |
১৮.৫—২৪.৯ | স্বাভাবিক ওজন |
২৫.০—২৯.৯ | অতিওজন বা ওভারওয়েট |
৩০.০—৩৪.৯ | শ্রেণী ১ স্থূলতা |
৩৫.০—৩৯.৯ | শ্রেণী ২ স্থূলতা |
≥ ৪০.০ | শ্রেণী ৩ স্থূলতা |
বি এম আই (BMI)গণনা করা হয় বস্তুর ভরকে তার উচ্চতার বর্গ দিয়ে ভাগ করে, সাধারণত এটি প্রকাশ করা হয় মেট্রিক অথবা মার্কিন কাস্টোমারি একক পদ্ধতিতে.
- মেট্রিক:
- মার্কিন কাস্টোমারি এবং রাজকীয় বা ইম্পিরিয়াল:
যেখানে বস্তুর ওজন পাউণ্ড-এ এবং in বস্তুর উচ্চতা মাপা হয় ইঞ্চি-তে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু WHO)-র প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সংজ্ঞাটি তৈরি হয় ১৯৯৭ সালে এবং তা প্রকাশিত হয় ২০০০সালে, ডানদিকের টেবিলে তা দেখানো হয়েছে। কিছু সংস্থা হু (WHO)-র সংজ্ঞায় বেশ কিছু বদল এনেছে। শল্য চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্রে শ্রেণী ৩ স্থূলতাকে আরো কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যার সঠিক মান অবশ্য এখনও উলটো পালটা।
- যে কোনো বিএমআই (BMI) ≥ ৩৫ অথবা ৪০ হলে তা প্রবল স্থূলতা
- বিএমআই (BMI) ≥ ৩৫ অথবা ৪০—৪৪.৯ অথবা ৪৯.৯ তা ব্যাধিগ্রস্ত স্থূলতা
- বিএমআই (BMI) যদি ≥ ৪৫ অথবা ৫০ হয় তবে তা অতিরিক্ত স্থূলতা
কম বি এম আই (BMI)র কারণে ককেশীয় অঞ্চলের তুলনায় এশীয় জনসমষ্টির মধ্যে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বেশ কিছু নেতিবাচক পরিণতি হয়েছিল, কিছু দেশ স্থূলতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে; ২৫-এর বেশি বি এম আই (BMI)হলেই জাপানীরা তাকে স্থূলতা বলে, চীনারা আবার ২৮—এর বেশি হলে তা বলে।
স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
শরীরের ওজন অত্যধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন ধরনের রোগের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়, বিশেষত কার্ডিওভাসকুলার সংক্রান্ত রোগ, দ্বিতীয় স্তরের মধুমেহ বা ডায়াবেটিস মেলাইটাস টাইপ টু, নিদ্রাহীনতা, কয়েক ধরনের ক্যান্সার এবং অস্টিওআর্থারাইটিস জাতীয় রোগের সম্ভাবনা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় স্থূলতা আখেরে মানুষের আয়ু কমিয়ে দেয়।
মৃত্যুহার
স্থূলতা এমন একটা রোগ, যাকে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে খাড়া করা যেতে পারে, তবে একে ঠেকানোও যেতে পারে। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেকেই সমীক্ষা করে দেখেছেন যে, বডি মাস ইনডেক্স (BMI) যাঁদের ২২.৫–২৫ kg/m2 এবং ধূমপায়ী নন তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই কম এবং যে ধূমপায়ীদের বডি মাস ইনডেক্স (BMI) ২৪–২৭ kg/m2 তাদের ধীরে ধীরে এই ঝুঁকির মাত্রা বাড়ে। বিশেষ করে ষোলো বছরের বেশি বয়স, ঋতুচক্র হয়ে গেছে এমন মেয়েদের BMI ৩২-র বেশি হলে, তাদের মৃত্যুহার অন্যান্যদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে স্থূলতাজনিত রোগের শিকার হয়ে মারা যান ১১১,৯০৯থেকে ৩৬৫,০০০জন। আর ইউরোপের দেশগুলিতে এই সংখ্যা ১০ লক্ষের (৭.৭%) কাছাকাছি। স্থূলতার কারণে মানুষের গড়ে ৬-৭ বছর জীবনকাল কমে আসে; যাঁদের BMI ৩০—৩৫-র মধ্যে তাদের জীবনকাল দুই থেকে চার বছর কমতে পারে বলে মনে করা করা হয়, যাঁরা অত্যধিক স্থূল বা মোটা (BMI > ৪০) তাদের আয়ু প্রায় দশ বছর হ্রাস পেতে পারে।
অসুস্থতা
স্থূলতার কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা থাকে। মূল সমস্যার পাশাপাশি আরো বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়, যেমন মেটাবলিক সিনড্রোম বা কার্ডিওভাসকুলার রোগ ও মধুমেহ বা ডায়াবেটিস রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে বেশি কোলেস্টরল ও উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইড-র মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
স্থূলতা হয় সরাসরি জটিলতা সৃষ্টি করে, না হয় সুষম পুষ্টির অভাব ও বসে বসে কাজ করার প্রবণতায় পরোক্ষে জটিলতা তৈরি করে। স্থূলতা ও নির্দিষ্ট কয়েকটি পরিস্থিতির মধ্যে যোগসূত্রের অদলবদল ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ের ডায়াবেটিস হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। অতিরিক্ত মেদের কারণে পুরুষদের ক্ষেত্রে ৬৪% এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৭৭%-র ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
শরীরে মেদের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে নানা সমস্যা দেখা দেয়, একে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, প্রথমত একে রোগের উৎস বলে মনে করা হয় যেমন, অস্টিওআর্থারাইটিস, নিদ্রাহীনতা, সামাজিক কলঙ্ক এবং দ্বিতীয়ত রক্তে স্নেহজাতীয় পদার্থের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কার্ডিওভাসকুলার রোগ, মাদক-হীন চর্বিযুক্ত যকৃতের রোগ দেখা দিতে পারে। শরীরে চর্বির পরিমাণ বেড়ে গেলে ইনসুলিন সেভাবে সাড়া দেয় না, পরবর্তীকালে ইনসুলিন শর্করাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে। চর্বির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেলে প্রদাহ হতে পারে এবং রক্ত জমাট বাঁধতে পারে।
চিকিৎসা ক্ষেত্র | শর্ত | চিকিৎসা ক্ষেত্র | শর্ত |
---|---|---|---|
কার্ডিওলজি |
|
ত্বক-বিজ্ঞান |
|
এন্ডক্রিনলোজি এবং রিপ্রোডাকটিভ মেডিসিন |
|
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল |
|
স্নায়ুবিদ্যা |
|
অন্কলোজি |
|
মনোরোগবিদ্যা |
|
রেস্পিরলোজি |
|
বাতরোগসংক্রান্ত বিজ্ঞান এবং অস্থির চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিজ্ঞান |
|
মূত্রব্যবস্থা-বিজ্ঞান এবং নেফ্রোলজি |
|
ওবেসিটি সারভাইভাল প্যারাডক্স (স্থূলতার মধ্যেও বেঁচে থাকার স্ববিরোধিতা)
সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থূলতার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নেতিবাচক পরিণতি সম্পর্কে যদিও যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রয়েছে, কিন্তু কিছু জনগোষ্ঠীর বর্ধিত বি এম আই (BMI)-র প্রভাব স্বাস্থ্যের ওপর ভালোই হয়, এই লক্ষ্মণকে বলা হয় ওবেসিটি সারভাইভাল প্যারাডক্স।[ ১৯৯৯সালে এই স্ববিরোধী বিষয়টি প্রথম দেখা যায় অতিওজন ও ভীষণ মোটা মানুষের শরীরে হেমোডায়ালিসিস করার সময় এবং পরবর্তীকালে যাদের হৃদযন্ত্র বিকল ও পেরিফেরাল আর্টারি ডিসিস (PAD) হয়েছে তাদের মধ্যেও এটি দেখা গেছে।
হৃদযন্ত্র বিকল হয়েছে এমন মানুষের যাঁদের বি এম আই (BMI) ৩০.০থেকে ৩৪.৯ –এর মধ্যে তাদের মধ্যে স্বাভাবিক ওজনের মানুষের তুলনায় মৃত্যুহার কম। বাস্তবে দেখা যায় যে মানুষের ওজন হ্রাস পাচ্ছে তারা ক্রমবর্ধমানভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অন্য ধরনের হৃদরোগেও একই বিষয় লক্ষ্য করা যায়। স্বাভাবিক ওজন অথচ হৃদযন্ত্রের ব্যাধি আছে যাদের তাদের তুলনায় ক্লাস I স্থূলতা রয়েছে ও হৃদরোগও রয়েছে এমন মানুষের মধ্যে হৃদযন্ত্রের আরো সমস্যা ঘটার হার মোটেই বেশি নয়। বেশি মাত্রার স্থূলতায় আরো অনেক ঘটনার ঝুঁকি যদিও বেড়ে যায়। এমনকি কার্ডিয়াক বাইপাস সার্জারির পরও অতিওজন ও ভীষণ মোটা মানুষের মধ্যে মৃত্যুহার বাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে টিকে থাকার এই উন্নতিকে কার্ডিয়াক কোনো ঘটনার পর মোটা মানুষের চিকিৎসায় আরো আক্রমণাত্মক কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি নিতে পারে বলে ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে পেরিফেরাল আর্টারি ডিসিস (PAD) আছে এমন মানুষের মধ্যে যদি কেউ ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিসিস (COPD) হিসেব করে তবে স্থূলতার কোনো সুবিধাই ধরা পড়বে না।
কারণসমূহ
প্রথমত, ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রয়োজনের তুলনায় অত্যধিক মাত্রায় শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ এবং দ্বিতীয়ত শর্করা গ্রহণের পরিমাণের তুলনায় পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের অভাবের যৌথ সংমিশ্রণকেই অতি স্থূলতার ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সীমিত কিছু ক্ষেত্রে জেনেটিকস, চিকিত্সা সংক্রান্ত অথবা মানসিক অসুস্থতাই এর প্রাথমিক কারণ। বিপরীত ক্ষেত্রে, সামাজিক পর্যায়ে অতি স্থূলতার হার বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে সহজলভ্য এবং রুচিকর খাবার, গাড়ির উপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়া এবং উৎপাদন যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়াকে।
সাম্প্রতিক সময়ে অতি স্থূলতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ২০০৬ সালের এক পর্যালোচনায় আরও দশটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করা হয়। (১) অপর্যাপ্ত ঘুম, (২) এণ্ডোক্রাইনে ব্যাঘাত সৃষ্টি (পরিবেশগত দুষণ যার সঙ্গে লিপিড মেটাবলিজম যুক্ত), (৩) পরিবেশে তাপমাত্রার তারতম্য কমে যাওয়া, (৪) ধূমপান খিদে কমিয়ে দেয় বলে ধূমপানের হার কমানো, (৫) ওষুধ ব্যবহারের হার বেড়ে যাওয়া যার থেকে ওজন বাড়তে পারে (যেমন, প্রতিনিধিত্ব করে না এমন মনোরোগবিরোধী), (৬) প্রাচীন এবং বয়স্কদের মধ্যে সমানুপাতিক হারে ভারি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা, (৭) বেশি বয়সে গর্ভবতী হওয়া (যার কারণে শিশুদের মধ্যেও অতি স্থূল হওয়ার লক্ষণ দেখা যেতে পারে), (৮) যে এপিজেনেটিক ঝুঁকি থাকে সেটাও বংশপরম্পরায় বাহিত হয়, (৯) উচ্চ বি এম আই-য়ের জন্য স্বাভাবিক নির্বাচন এবং (১০) বিশেষ শ্রেণীভুক্ত মিলনের ফলে অতি স্থূলতার ঝুঁকির কারণগুলি এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হতে পারে (এর ফলে যদিও একান্তভাবে অতি স্থূল ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে যাবে না, কিন্তু জনসংখ্যার গড় ওজন বাড়িয়ে দেবে)। অতি স্থূলতা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে এই সমস্ত কারণগুলির প্রভাবের সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। যদিও এই প্রমাণগুলি এখনো পুরোপুরি চূড়ান্ত নয়। এমনকি গবেষকরাও বলছেন, আগের পরিচ্ছেদে যে কারণগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলির তুলনায় এই কারণগুলি কম প্রভাবশালী।
সাধারণ খাদ্য
বিভিন্ন দেশ এবং বিভিন্ন অঞ্চলে মাথা পিছু খাদ্য গ্রহণ এবং খাদ্যবিধি সংক্রান্ত শক্তি সরবরাহ নির্দিষ্টভাবেই আলাদা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে এর পরিবর্তনও হয়েছে। ১৯৭০’র গোড়ার দিক থেকে শুরু করে ১৯৯০’র শেষ দিক পর্যন্ত একমাত্র পূর্ব ইউরোপ ছাড়া বিশ্বের সব প্রান্তেই প্রতি দিন মাথা পিছু মানুষের ( যে পরিমাণ খাদ্য কেনা হয়) গড় ক্যালোরি পাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সর্বাধিক পাওয়া যায়। ১৯৯৬ সালে এর পরিমাণ ছিলো ৩৬৫৪ক্যালোরি। ২০০৩ সালে আবার তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৭৫৪ক্যালোরিতে। ১৯৯০’এর শেষ দিকে ইউরোপীয়দের মাথাপিছু ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ ছিলো ৩৩৯৪, এশিয়ার উন্নয়নশীল এলাকাগুলিতে মাথাপিছু ক্যালোরি গ্রহণ ছিলো ২৬৪৮ এবং উপ-সাহারার আফ্রিকার দেশগুলিতে মাথা পিছু ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ ছিলো ২১৭৬। পূর্ণ ক্যালোরি গ্রহণের সঙ্গে অতি স্থূলতার যোগ রয়েছে।
ব্যাপক মাত্রায় পুষ্টির নির্দেশিক পাওয়া গেলেও সেটা অতিরিক্ত খাওয়া এবং অত্যন্ত খারাপ খাদ্যাভ্যাসের পছন্দের বিষয়টিকে খুব কমই সম্বোধন করতে পেরেছে। ১৯৭১ থেকে ২০০০সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অতি স্থূলতার হার ১৪.৫শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০.৯শতাংশ হয়েছে। ঐ একই সময়ের মধ্যে, ক্যালোরি গ্রহণের গড় পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে, প্রতি দিন গড় ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যায় ৩৩৫ (১৯৭১সালে ১৫৪২ এবং ২০০৪সালে তা বেড়ে হয় ১৮৭৭)। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে দৈনিক এই গড় বৃদ্ধির হার ছিলো ১৬৮ক্যালোরি (১৯৭১সালে ২৪৫০ এবং ২০০৪সালে ২৬১৮ক্যালোরি)। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত এই ক্যালোরি গ্রহণের প্রাথমিক উত্স ছিলো চর্বি জাতীয় খাদ্যের তুলনায় কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া। এই অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেটের প্রাথমিক উত্স ছিলো মিষ্টিযুক্ত পানীয়। এখন আমেরিকার সাবালক যুব সমাজের মধ্যে এই মিষ্টিযুক্ত পানীয়ের দৈনিক ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ প্রায় ২৫শতাংশ বেড়ে গেছে। এখন অতি স্থূলতা বাড়ার কারণ হিসেবে মিষ্টিযুক্ত পানীয় খাওয়াকেই মনে করা হচ্ছে।
যতো বেশি পরিমাণে শক্তি-ঘন, বেশি পরিমাণে ফাস্ট-ফুডের দিকে সমাজের নির্ভরতা ক্রমেই বাড়তে লাগলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফাস্ট-ফুড গ্রহণ এবং অতি স্থূলতার মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত বেশি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ালা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফাস্ট-ফুড গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে গেছে তিনগুণ এবং ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে এই সব খাবার থেকে ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যায় চারগুণ।
কৃষিনীতি এবং প্রযুক্তির কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে খাদ্যের দাম খুব কম। মার্কিন খামার বিলের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভুট্টা, সোয়া, গম এবং চালের উপর যে ভরতুকি রয়েছে সে কারণে ফল এবং সবজির তুলনায় প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মূল উত্সের দাম অনেক কম।.
অতি স্থূল (মোটা) ব্যক্তিরা সব সময়ই তাদের খাদ্য গ্রহণের মাত্রাকে স্বাভাবিক ওজনের ব্যক্তিদের তুলনায় কমিয়ে দেখায়। একটি ক্যালোরিমিটার ঘরে মানুষের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে এবং সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া গেছে।
বসে কাজের জীবনশৈলী
অতি স্থূলতার ক্ষেত্রে বসে কাজের জীবনশৈলী একটা বড়ো ভুমিকা পালন করে। গোটা বিশ্বই এখন কম শারীরিক পরিশ্রমের কাজের দিকে ঝুঁকছে। বিশ্বের জনসংখ্যার ৬০শতাংশই এখন অপর্যাপ্ত শারীরিক কসরত করতে পারে। এর প্রাথমিক কারণ হলো কোনো বস্তু এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বহন করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া এবং বাড়িতে শ্রমশক্তি বাঁচানো প্রযুক্তির অধিক প্রচলন। হাঁটা এবং শারীর শিক্ষা কমে যাওয়ার কারণে শিশুদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে শারীরিক কসরতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সক্রিয় অবকাশের সময় শারীরিক ক্রিয়াকর্মের প্রতি ঝোঁক বিশ্বে কমে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশ করেছে যে সারা বিশ্বেই মানুষ এখন কম সক্রিয় আনন্দের দিকে ঝুঁকছে। আবার ফিনল্যান্ডের এক সমীক্ষায় পাওয়া গেছে, এই হার কিছুটা বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে অবকাশকালীন শারীরিক ক্রিয়াকলাপ সেরকম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি।
টেলিভিশন দেখার সময় এবং অতি স্থূলতার ঝুঁকির মধ্যে শিশু এবং বয়স্ক উভয়ের ক্ষেত্রেই একটা সম্পর্ক আছে। ২০০৮সালের এক মেটা-বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৭৩টির মধ্যে ৬৩টিতেই (৮৬%) দেখানো হয়েছে, শিশুদের মধ্যে অতি স্থূলতা যে বাড়ছে তার কারণ হলো শিশুদের মিডিয়ায় প্রদর্শণের হার বেড়ে যাওয়া এবং সমানুপাতিক হারে টেলিভিশন দেখারও সময় বেড়ে যাওয়া।
জীনতত্ত্ব বা বংশানুগতি সম্বন্ধীয়
অন্য অনেক চিকিত্সা সংক্রান্ত পরিস্থিতির মতোই, অতি স্থূলতা হলো বংশানুগতি এবং পরিবেশের কারণগুলির মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলাফল। বিভিন্ন জিনে পলিমোরফিজমস নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষুধা এবং বিপাকীয় ক্রিয়াকে। যার ফলে যথেষ্ট পরিমাণ ক্যালোরির উপস্থিতিতে অতি স্থূলতামুখী করে তোলে একে। ২০০৬ সালের হিসেব অনুযায়ী, ৪১টি এমন ক্ষেত্র পাওয়া গেছে যেখানে অতি স্থূলতার সঙ্গে অণুকূল পরিবেশের উপস্থিতির যোগাযোগ পাওয়া গেছে। কত সংখ্যক জনসংখ্যার উপর পরীক্ষা করা হচ্ছে তার ভিত্তিতে বংশানুগতির কারণেই অতি স্থূলতার শতকরা হার বিভিন্ন রকম। এই হার হলো ৬% থেকে ৮৫%।
বিভিন্ন রোগের লক্ষণে অতি স্থূলতা হলো একটা বিরাট কারণ। যেমন প্রাডের-উইলি রোগলক্ষণ, বারডেল-বিয়েডল্ রোগলক্ষণ, কোহেন রোগলক্ষণ এবং এম ও এম ও(MOMO) রোগলক্ষণ। (‘রোগলক্ষণহীন অতি স্থূলতা’ এই শব্দ বন্ধটি কখনো ব্যবহার করা হয় এই সমস্ত অবস্থাগুলিকে বাদ দিয়ে।) যে সব মানুষের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি মারাত্মক অতি স্থূলতা লক্ষণ দেখা যায় (১০ বছর বয়সের আগে এবং স্বাভাবিকের তুলনায় বডি মাস ইণ্ডেক্স মাপকাঠির তিন স্তর নিচে থাকাকে এক্ষেত্রে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে), 7% ক্ষেত্রেই মনে করা হয় ডি এন এ’র রূপান্তরই এর একমাত্র কারণ।
যে সমস্ত সমীক্ষায় নির্দিষ্ট জিনের তুলনায় বংশপরম্পরার উপর বেশি নজর দেওয়া হয়েছে সেখানে পাওয়া গেছে যে ৮০%ক্ষেত্রেই দেখা গেছে দুজন অতি স্থূল মা-বাবার সন্তানরাও অতি স্থূলই হয়। উলটোদিকে ১০শতাংশেরও কম ক্ষেত্রে এও দেখা গেছে দুজন স্বাভাবিক ওজনের মা-বাবার সন্তান অতি স্থূল হয়।
থ্রিফ্টি জিন হাইপোথিসিস সিদ্ধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে সেই ধারণাকে যাতে বলা হয় নির্দিষ্ট জাতি গোষ্ঠী সমগোত্রীয় আবহাওয়ায় বেশি স্থূলতা প্রবণ। বিরল অতিপ্রাচুর্যের সময় শক্তি সঞ্চয় করার মতো তাদের ক্ষমতার ফলে চর্বি যখন খাদ্যের যোগান ওঠানামা করে তখন এই গুণ সুবিধার হয় এবং দুর্ভিক্ষের সময় ব্যক্তিগতভাবে সেই চর্বি থেকে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। চর্বি মজুত করার এই প্রবণতা যদিও সমাজে খাদ্য সরবরাহ সঠিক রাখতে সাহায্য করে। এটা একটা অণুমিত কারণ যে পিমা ইণ্ডিয়ান যারা মরুভূমি বাস্তুতন্ত্রের উদ্ভাবন করেছে যখন তারা পশ্চিমী দুনিয়ায় এলো তাদের মধ্যে স্থূলতা অনেক বেশি দেখা যেতে শুরু করলো।
চিকিৎসা সংক্রান্ত এবং মানসিক অসুস্থতা
নির্দিষ্ট কয়েকটি শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতা এবং ওষুধপ্রস্তুতকারী বস্তু যা দিয়ে তাদের চিকিত্সা করা হয়, এগুলির ফলে এদের মধ্যে অতি স্থূলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। চিকিৎসা সংক্রান্ত যে অসুস্থতার জন্য অতি স্থূলতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় তারমধ্যে রয়েছে কয়েকটি অস্বাভাবিক লক্ষণ (উপরে তালিকাভুক্ত) এবং একইসঙ্গে জন্মগত এবং অর্জিত অবস্থা: হাইপোথাইরয়েডিজম, কুশিং-এর লক্ষণ, বৃদ্ধি সংক্রান্ত হরমোনের অভাব এবং খাওয়ার গণ্ডগোল: প্রচুর মদ্যপানের ব্যাধি এবং রাতে খাওয়ার লক্ষণ। যদিও অতি স্থূলতাকে মানসিক ব্যাধি বলে মনে করা হয় না এবং সেই কারণেই মানসিক অসুস্থতা হিসেবে ডি এস এম-আই ভি আর’এর তালিকাভুক্ত নয়।
নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের কারণে ওজন বাড়তে পারে অথবা শারীরিক গঠনে পরিবর্তন আসতে পারে; এর মধ্যে রয়েছে ইনস্যুলিন, সালফোনাইল্যুরিয়াস, থিয়াজোলিডাইনেডিয়োনেস, মানসিকবিরোধিতার প্রতিনিধিত্ব করে না এমন, অবসাদনিরোধক স্টেরয়েড, নির্দিষ্ট কয়েকটি শারীরিক আলোড়নবিরোধী (ফেনাইটয়েন এবং ভালপ্রোয়েট), পাইজোটিফেন এবং হরমোনের একপ্রকার জন্মনিরোধক বড়ির কারণে এই পরিবর্তন আসতে পারে।
সামাজিক নির্ধারণকারী
অতি স্থূলতাকে বুঝতে যদিও বংশগত প্রভাবকে বোঝাও খুবই গুরত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা নির্দিষ্ট কিছু দেশে বা বিশ্বে এর নাটকীয় যে বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে তাকে বিশ্লেষণ করতে পারেনি। যদিও এটা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে অত্যধিক মাত্রায় ক্যালোরি খরচের তুলনায় ক্যালোরি গ্রহণের কারণে অতি স্থূলতা দেখা দেয়। সামাজিক ক্ষেত্রে এই দুই উপাদানের পরিবর্তনের কারণ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। এর কারণ সম্পর্কে নানা ধরনের তত্ত্ব আছে কিন্তু বহু মানুষের বিশ্বাস এর পিছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণের সমাহার।
গোটা বিশ্বেই সামাজিক শ্রেণী এবং বি এম আইয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের পার্থক্য আছে। ১৯৮৯সালে এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে উন্নত দেশগুলিতে উচ্চ সামাজিক শ্রেণীর মহিলাদের মধ্যে অতি স্থূলতা কম দেখা যায়। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর পুরুষের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায় না। উন্নয়নশীল বিশ্বে উচ্চ সামাজিক শ্রেণীর মহিলা, পুরুষ, শিশুদের অতি স্থূলতার হার অনেক বেশি দেখা যায়। ২০০৭ সালে এই পর্যালোচনার একটি সংশোধিত পর্যালোচনায় একই সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছিলো, কিন্তু সেটা অনেক দুর্বল ছিলো। এই পারস্পরিক সম্পর্কের শক্তি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্বায়নের প্রভাবকেই মনে করা হচ্ছে। উন্নত দেশগুলির মধ্যে, বয়স্কদের অতি স্থূলতার মাত্রা এবং কিশোরদের মধ্যে অতি ওজনের হারের মধ্যে যে সম্পর্ক আছে তার সঙ্গে আয়ের অসঙ্গতি জড়িত। একই ধরনের সম্পর্ক দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলিতে: এমনকি উচ্চ সামাজিক শ্রেণীভুক্ত, অনেক সাবালকরাও আরও অনেক অসম রাজ্যগুলির মতো অতি স্থূল।
শারীরিক ভর সূচক বা বি এম আই এবং সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি অনেক রকমভাবে ব্যাখ্যা করে দেখানো হয়েছে। এটা মনে করা হোত, উন্নত দেশগুলিতে সম্পদশালীরা আরও অনেক বেশি পুষ্টিকর খাদ্য কেনার ব্যাপারে সক্ষম। কিন্তু ওজন কম রাখার ব্যাপারে তাদের উপর অনেক বেশি সামাজিক চাপ থাকে। একইসঙ্গে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার বিরাট প্রত্যাশার পাশাপাশি তাদের সামনে অনেক সুযোগও থাকে। অণুন্নত দেশগুলিতে একটি বিরাট আকৃতির শরীরের মাপে খাবার কেনার ক্ষমতা, শারীরিক পরিশ্রমসহ উচ্চ শক্তির ব্যয়ের পরিমাণ এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ পর্যবেক্ষণের ধরনে অংশগ্রহণ করেছে। কারোর জীবনে শরীরের ভরের দিকে মানুষের মনোভাবও অতি স্থূলতার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করে। বন্ধু, ভাই-বোন এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ভর সূচক পরিবর্তন হওয়ার পারস্পরিক সম্পর্ক পাওয়া গেছে। চাপ এবং সম্ভাব্য সামাজিক পদমর্যাদা অতি স্থূলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কোনো ব্যক্তির ওজনের উপর ধূমপানের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। যারা ধূমপান ছেড়ে দেয় ১০বছর সময়ের ব্যবধানে তাদের মধ্যে পুরুষদের গড়ে ৪.৪কিলোগ্রাম (৯.৭পাউণ্ড) এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে 5কিলোগ্রাম (১১পাউণ্ড) ওজন বাড়ে। যদিও, ধূমপানের হার পরিবর্তনের সঙ্গে অতি স্থূলতার সম্পূর্ণ হারের উপর কমই প্রভাব ফেলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ্য করা গেছে একজন ব্যক্তির যতোগুলি সন্তান থাকে তারসঙ্গে ঐ ব্যক্তির অতি স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ার সম্পর্ক রয়েছে। প্রতি সন্তান জন্ম পিছু একজন মহিলার ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেড়ে যায় ৭%, যেখানে একজন পুরুষের ক্ষেত্রে সন্তান প্রতি এই ঝুঁকি বেড়ে যায় ৪%। এটা আংশিকভাবে সত্য যে, পশ্চিমী বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে নির্ভরশীল সন্তান থাকার অর্থ কম শারীরিক পরিশ্রম করা।
উন্নয়নশীল দেশে শহরে পরিণত হওয়াও অতি স্থূলতার হার বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা পালন করছে। চীনে সামগ্রিকভাবে অতি স্থূলতার হার ৫%—এরও কম, আবার কিছু শহরে অতি স্থূলতার হার ২০শতাংশেরও বেশি।
উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অতি স্থূলতার হার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে গোড়ার দিকের জীবনে অপুষ্টির একটা বড়ো ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এণ্ডোক্রাইন অপুষ্টির সময়ে যে পরিবর্তন ঘটে তার থেকে সম্ভবত ক্যালোরি পাওয়া সহজ হয়ে গেলে তা চর্বি জমাকে বাড়িয়ে দেয়।
সংক্রামক প্রতিনিধিসমূহ
খাদ্য রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় সংক্রামক প্রতিনিধির উপস্থিতি সংক্রান্ত সমীক্ষা এখনো তার প্রাথমিক স্তরেই রয়ে গেছে। রোগা এবং অতি স্থূল ব্যক্তির মধ্যে যে পার্থক্য থাকে তা অন্ত্র এলাকাতেই লক্ষ্য করা গেছে। অতি স্থূল এবং রোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অন্ত্র এলাকায় তার হজমের ক্ষমতাকে যে প্রভাবিত করে তার লক্ষণ নির্দেশ করা হয়েছে। হজমের ক্ষমতার এই স্পষ্ট পরিবর্তনের ফলে এটা মনে করা হচ্ছে যে অতি স্থূল ব্যক্তি অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। এই পার্থক্যগুলি সরাসরি এই কারণেই নাকি অতি স্থূলতার ফলাফল তা অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে । মানুষ এবং কয়েকটি বিভিন্ন ধরনের পশু প্রজাতির মধ্যে সংক্রামক রোগ এবং অতি স্থূলতার মধ্যে একটা যোগসূত্র পাওয়া গেছে। তবে অতি স্থূলতার হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কতোটা পরিমাণে এই যোগসূত্র কাজ করেছে তা এখনো সুনিশ্চিত করে বলা যায়নি।
প্যাথোফিজিওলজি
স্থূলতা মোকাবিলার সম্ভাব্য বেস কিছু প্যাথোফিজিওলজিক্যাল প্রণালী সারসংক্ষেপ করেছে ফ্লায়ার। ১৯৯৪-এ লেপটিন আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত গবেষণার ক্ষেত্রে একেবারে কিছুই হয়নি। এই আবিষ্কারের পর থেকে আরো অনেক হরমোন সংক্রান্ত প্রণালী নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ হয়েছে যাতে খিদে ও খাদ্য গ্রহণের নিয়মবিধি, অ্যাডিপোজ কোষের মজুতের ধরন ও ইনস্যুলিন রেজিস্ট্যান্স বিকাশের বিষয়গুলিও রয়েছে। লেপটিন আবিষ্কারের পর থেকে ঘ্রেলিন, ইনসুলিন, ওরেক্সিন, পি ওয়াই ওয়াই (PYY) ৩—৩৬, কলেসিসটোকিনিন, অ্যাডিপোনেকটিন ছাড়াও আরো অনেক মেডিয়েটার নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। অ্যাডিপোকিনস মেডিয়েটারটি তৈরি করে অ্যাডিপোস কলা; তার কার্যকারিতা স্থূলতা সংক্রান্ত বেশ কিছু রোগে রকমফের ঘটাতে পারে বলে মনে করা হয়। লেপটিন ও ঘ্রেলিনকে খিদের ওপর তাদের প্রভাবের বিচারে একে অপরের পরিপূরক বলে মনে করা হয়। কারণ ঘ্রেলিন তৈরি হয় স্টমাক মডিউলেটিং শর্ট টার্ম অ্যাপেটাইটিভ কন্ট্রোলের মাধ্যমে (অর্থাৎ পাকস্থলী খালি থাকলে খেতে হবে এবং যখন তা ভর্তি থাকবে খাওয়া বন্ধ থাকবে)। আর শরীরে চর্বির মজুত সঙ্কেত দিতে লেপটিনকে তৈরি করে অ্যাডিপোজ কোষ এবং এই লেপটিন দীর্ঘসময়ের জন্য খিদে নিয়ন্ত্রণে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে (অর্থাৎ যখন চর্বির মজুত কম তখন বেশি খাও এবং যখন মজুত বেশি কম খাও)। যদিও ব্যক্তিগতভাবে যেসব স্থূল মানুষের মধ্যে লেপটিনের ঘাটতি আছে তাদের সামান্য অংশের ওপর লেপটিনের ব্যবস্থাপনা বেশ কার্যকরী হতে পারে, বেশিরভাগ মোটা মানুষেকেই লেপটিন প্রতিরোধী বলে মনে করা হয় এবং এদের মধ্যে লেপটিনের উচ্চ স্তর লক্ষ্য করা যায়। এই প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে কেন লেপটিন ব্যবস্থাপনা মোটা মানুষের খিদে কমিয়ে দিতে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে না তার ব্যাখ্যায়।
লেপটিন ও ঘ্রেলিন যেহেতু সীমান্তবর্তী অবস্থায় তৈরি হয় তাই তারা কেন্দ্রীয় স্নায়ু ব্যবস্থায় তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে খিদে নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে, এরা এবং খিদে সংক্রান্ত অন্যান্য হরমোনগুলি মস্তিষ্কের কেন্দ্রে হাইপোথ্যালামাস নামে অঞ্চলে কাজ করে সেকান থেকেই খাবার খাওয়া ও শক্তি খরচের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয়। হাইপোথ্যালামাসের মধ্যে বেশ কিছু প্রদক্ষিণ পথ রয়েছে খিদেকে সংহত করতে জাদের ভূমিকা রয়েছে, এগুলির মধ্যে সবচেয়ে ভালো বলে বিবেচনা করা হয় মেলানোকর্টিন পাথওয়ে। আরকুয়েট নিউক্লিয়াস নামে হাইপোথ্যালামাসের একটি অঞ্চল থেকে প্রদক্ষিণ পথ শুরু হয় যার শেষাংশ থাকে ল্যাটারাল হাইপোথালামাস (LH) এবং ভেন্ট্রোমেডিয়াল হাইপোথ্যালামাস (VMH) -এ, এরা যথাক্রমে হলো মস্তিসকের খাবার খাওয়া ও পূর্ণ পরিতৃপ্তির কেন্দ্র। আরকুয়েট নিউক্লিয়াস দুটি ভিন্ন ধরনের গোষ্ঠীরনিউরোন দিয়ে তৈরি। প্রথম গোষ্ঠীটি একই সঙ্গে নিউরোপেপটাইড ওয়াই(NPY) ও অ্যাগুইটি-রিলেটেড পেপটাইড (AgRP) এবং উদ্দীপনা গ্রহণ হয় LH ও VMH -এর তালিকাসহ। দ্বিতীয় গোষ্ঠোটি হলো প্রো-ওপিওমেলানোকর্টিন (POMC) ও কোকেইন- ও অ্যাম্ফিটামিন-নিয়ন্ত্রিত ট্রান্সস্ক্রিপ্ট (CART) এবং উদ্দীপনা গ্রহণ হয় LH ও VMH -এর সংযমসহ। সর্বশেষে, NPY/AgRP নিউরোন খাবার খেতে উদ্কদীপনা যোগায় ও পূর্ণ পরিতৃপ্তির তালিকা বানায়, যেখানে POMC/CART নিউরোন পূর্ণ পরিতৃপ্তিকে উদ্দীপিত করে দেয় ও খাবার খেতে সংযত করে। লেপটিনের মাধ্যেমেই এই উভয় গোষ্টীর আরকুয়েট নিউক্লিবাস নিউরোন নিয়ন্ত্রিত হয়। লেপটিন যেমন NPY/AgRP গোষ্ঠীর সংযম করে আবার POMC/CART গোষ্ঠীকে উদ্দীপিত করে ফেলে। লেপটিন সঙ্কেতের এই ঘাটতিকে হয় লেপটিন ঘাটতি বা লেপটিন প্রতিরোধের মাধ্যমে বাড়তি খাওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এর কিছু আবার জিনগত এবং এভাবেই স্তূলতার প্রকারভেদ পায়।
ব্যবস্থাপনা
অতি স্থূলতা রোগের প্রধান চিকিত্সার মধ্যে রয়েছে প্রথমত কম ক্যালরিযুক্ত পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস এবং দ্বিতীয়ত পর্যাপ্ত শারীরিক কসরত। কম ক্যালরিবিশিষ্ট সঠিক খাদ্যাভ্যাস কর্মসূচীর ফলে অল্প সময়ের মধ্যে ওজন কমানো সম্ভব, কিন্তু এই ওজনকে ওইভাবে কমিয়ে রাখা সমস্যার হতে পারে এবং মাঝে মাঝেই শারীরিক কসরতের প্রয়োজন পড়তে পারে। একইসঙ্গে কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার ঐ ব্যক্তির জীবনশৈলীর চিরদিনের অংশ হয়ে যেতে পারে। ওজন কমিয়ে তা দীর্ঘ সময়ের জন্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে সাফল্যের হার খুবই কম। এই সাফল্যের হার হলো ২—২০শতাংশ।
রোগ বিস্তার বা মহামারী সংক্রান্ত বিদ্যা
বিংশ শতাব্দীর আগে স্থূলতা খুবই বিরল ছিল; ১৯৯৭-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু WHO) আনুষ্ঠানিকভাবে স্থূলতাকে বিশ্বজুড়ে মহামারী বা গ্লোবাল এপিডেমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৫–এর হু (WHO)র হিসেব মতো কমপক্ষে ৪০কোটি প্রাপ্তবয়স্ক (৯.৮%) ভীষণ মোটা, এবং পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এর হার বেশি। ৫০অথবা ৬০বছর বয়সীদের মধ্যে স্থূলতার হার বেড়েছে এবং সামগ্রিক স্থূলতার হারের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় এর হার বেশি।
একটা সময়ে একে উচ্চ-আয়ের দেশের সমস্যা বলে বিবেচনা করা হতো, কিন্তু স্থূলতার হার এখন বিশ্বজুড়েই বাড়ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় বিশ্বেই। নাটকীয়ভাবে এই বৃদ্ধি সমচেয়ে বেশি নগর জীবনে লক্ষ্য করা যায়। সাব-সাহারান আফ্রিকাই বিশ্বের একমাত্র অবশিষ্ট এলাকা যেখানে স্থূলতা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়।
জনস্বাস্থ্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু WHO)-র অণুমান অতিওজন ও স্থূলতা খুব শীঘ্রই হয়তো কমপুষ্টি (আন্ডার নিউট্রিশন) ও সংক্রামক ব্যাধির (খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য যা সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ) মতো প্রথাগত জনস্বাস্থ্য সমস্যার জায়গা নেবে। তার বিস্তার, খরচ ও স্বাস্থ্যে তার প্রভাবের কারণেই স্থূলতা হলো একটা জনস্বাস্থ্য ও নীতি সম্পর্কিত সমস্যা।
জনসমষ্টির মধ্যে স্থূলতার ব্যাপক বিস্তারের জন্য দায়ী পরিবেশগত বিষয়গুলি বুঝে নিয়ে তা শোধরানোর প্রচেষ্টাই করছে জনস্বাস্থ্য। বাড়তি ক্যালোরি ভোগ ও শারীরিক কসরতের অনিচ্ছার কারণ যে বিষয়গুলি, তাও বদল করার সমাধান খোঁজা চলছে। চেষ্টা চলছে স্কুলগুলিতে রিইমবার্সড মিল প্রোগ্রাম চালু করার, শিশুদের কাছে সরাসরি জাঙ্ক ফুড বিপণনে রাশ টানার ও একই সঙ্গে চেষ্টা চলছে স্কুলে মিষ্টি পাণীয়ের সহজলভ্যতা কমিয়ে ফেলার। নাগরিক পরিবেশ গড়ে তোলার সময়েই চেষ্টা হচ্ছে পার্কের সুযোগ বাড়ানোর ও পায়ে চলার পথ বাড়ানোর।
বহু দেশ ও গোষ্ঠী স্থূলতা সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ১৯৯৮–এ প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘ক্লিনিকাল গাইডলাইনস অন দ্য আইডেন্টিফিকেশন ইভলিউশন অ্যাণ্ড ট্রিটমেন্ট অব ওভারওয়েট অ্যাণ্ড ওবেসিটি ইন অ্যাডাল্টস: দ্য এভিডেন্স রিপোর্ট’।] ২০০৬—এ কানাডিয়ান ওবেসিটি নেটওয়ার্ক ‘কানাডিয়ান ক্লিনিকাল প্র্যাক্টিস গাইডলাইনস (CPG) অন দ্য ম্যানেজমেন্ট অ্যাণ্ড প্রিভেনশন অব ওবেসিটি ইন অ্যাডাল্টস অ্যাণ্ড চিল্ডরেন’প্রকাশ করে। প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে অতিওজন ও স্থূলতা রুখতে এটি হলো একটি সুসংহত তথ্যপ্রমাণ ভিত্তিক নির্দেশিকা।
২০০৪-এ ব্রিটেনের রয়াল কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স, ফ্যাকাল্টি অব পাবলিক হেল্থ এবং রয়াল কলেজ অব পেডিয়াট্রিক্স অ্যাণ্ড চাইল্ড হেল্থ ‘স্টোরিং আপ প্রব্লেমস‘ নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যাতে ব্রিটেনের ক্রমবর্ধমান স্থূলতার সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। ঐ একই বছরে হাউস অব কমন্স -এর হেল্থ সিলেক্ট কমিটি প্রকাশ করে তাদের ‘মোস্ট কম্প্রিহেন্সিভ এনকোয়ারি [...] এভার আণ্ডারটেকেন" এতে গ্রেট ব্রিটেনের সমাজ ও স্বাস্থ্যের ওপর স্থূলতার প্রভাব ও সেই সমস্যার সম্ভাব্য প্রতিকারের কথা ছিল। 2006 -এ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেল্থ অ্যাণ্ড ক্লিনিকাল এক্সেলেন্স (NICE) স্থূলতা নির্ধারণ ও তার মোকাবিলার একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে, পাশাপাশি এতে স্থানীয় পরিষদের মতো স্বাস্থ্য বিষয়ক নয় এমন সংস্থাগুলির জন্য নীতি রূপায়ণের কথাও ছিল।
২০০৭ -এ স্যার ডেরেক ওয়ানলেস -এর প্রকাশিত একটি রিপোর্ট কিংস ফাণ্ড-এ হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় এখনই কিছু ব্যবস্থা না নিলে জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবাকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে। স্থূলতার ক্রমবর্ধ্বমান হার রোধে সুসংহত উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অবেসিটি পলিসি অ্যাকশন (ও পি এ OPA) কাঠামো বেশ কিছু পদ্ধতিতে ভাগ করেছে যেমন ‘আপস্ট্রিম’ নীতি, ‘মিডস্ট্রিম’ পলিসি, ‘ডাউনস্ট্রিম’ পলিসি। ‘আপস্ট্রিম’ নীতি সমাজ পরিবর্তনের ওপর নজর রাখে, স্থূলতা রুখতে ব্যক্তিগত আচরণ বদলের চেষ্টা করে ‘মিডস্ট্রিম’ পলিসি এবং বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের চিকিৎসার চেষ্টা করে ‘ডাউনস্ট্রিম’ পলিসি।
অর্থনৈতিক প্রভাব
স্বাস্থ্যগত প্রভাবের পাশাপাশি স্থূলতা আরো বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি করে যেমন চাকরিতে অসুবিধা ও ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়া। ব্যক্তিগত, কর্পোরেশনগত, সরকারি সমাজের সব স্তরেই এর প্রভাব অনুভূত হয়।
কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই খাদ্যপণ্যের বার্ষিক অণুমিত খরচ ৪০বিলিয়ন থেকে ১০০বিলিয়ন ডলার। ১৯৯৮–এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থূলতা খাতে চিকিৎসা খরচ ছিল ৭৮.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অথবা সমস্ত চিকিৎসা খরচের ৯.১%। কানাডায় আবার স্থূলতার জন্য অণুমিত খরচ ছিল ২ বিলিয়ন ডলার (মোট চিকিৎসা খরচের ২.৪%)।
স্থূলতা সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসা খরচ কমানোর জন্য স্থূলতা রোধ কর্মসূচীগুলিকে দেখা যায়। যদিও, বেশি আয়ের মানুষকে আরো চিকিৎসা খরচ বইতে হয়। গবেষকদের তাই মতামত হলো, স্থূলতা কমিয়ে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো যায়, তবে অন্যরকমভাবে এটা সামগ্রিক চিকিৎসা খরচ কমায়।
স্থূলতা সামাজিক কলঙ্ক ও চাকরিতে অসুবিধা তৈরি করতে পারে। স্বাভাবিক ওজনের অন্য সহকর্মীদের তুলনায় ভীষণ মোটা কর্মীদের অনুপস্থিতির হার বেশি হয়, অসুস্থতার জন্য তারা বেশি ছুটি নেয়, ফলে নিয়োগকর্তার খরচ বেড়ে যায় এবং উৎপাদনশীলতা কমে যায়। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে সব কর্মী বডি মাস ইন্ডেক্স (BMI) ১৮.৫—২৪.৯,তাদের মধ্যে থেকে যতজন চিকিৎসা বা ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত দাবি জানিয়েছে তাদের দ্বিগুণ সংখ্যার কর্মী এই সুবিধার জন্য দাবি জানিয়েছে যাদের বি এম আই (BMI) ৪০–এর বেশি। কর্মদিবস নষ্টের হিসেবে তারা ১২ গুণেরও বেশি। পড়ে গিয়ে অথবা ওঠার সময় এদের চোট পাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার, এভাবেই এরা চোট পায় শরীরের নিচের অংশে, হাতে বা কবজিতে অথবা পেছনে বা কোমরে। ইউ এস স্টেট অব আলাবামা এমপ্লয়িজ ইনস্যুরেন্স বোর্ড একটি বিতর্কিত পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে, তাতে বলা হয়েছে ভীষণ মোটা কর্মীদের প্রতি মাসে ২৫ডলার করে কেটে নেওয়া হবে যদি না তারা ওজন কমিয়ে স্বাস্থ্য ভালো করে। ২০১০–এর জানুয়ারি থেকে এই পদক্ষেপ কার্যকরী হবার কথা এবং এটি বলবত্ হবে সেই সব কর্মীর ওপর যাদের বি এম আই (BMI) ৩৫ kg/m2 –এর বেশি এবং একবছর বাদে যারা তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে ব্যর্থ হবে।
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ভীষণ মোটাদের খুব কমই কোনো কাজের জন্য ভাড়া করা হয়েছে এবং খুবই কম এদের পদোন্নতি হয়েছে। একই কাজের জন্য মোটা নয় এমন সহকর্মীর তুলনায় মোটাদের কম মজুরি দেওয়া হয়। গড়ে মোটা মহিলারা ৬% কম ও মোটা পুরুষরা ৩% কম কাজ করতে পারে।
এয়ারলাইন ও ফুড ইণ্ডাস্ট্রির মতো নির্দিষ্ট কিছু শিল্পের আবার বিশেষ কিছু চিন্তার কারণ আছে। স্থূলতার হার বেড়ে যাওয়ার কারণে এয়ারলাইনগুলির জ্বালানির খরচ বেড়ে যাচ্ছে, বসার জায়গা আরো চওড়া করার চাপ আসছে। ২০০০–এ মোটা যাত্রীদের বাড়তি ওজনের জন্য এয়ারলাইনগুলির ২৭৫মিলিয়ন ডলার বাড়তি জ্বালানি খরচ হয়েছে। আইনব্যবস্থায় অভিযোগ তোলা হচ্ছে যে তারা স্থূলতা বাড়াচ্ছে, তাই রেস্তোরার খরচ বাড়ছে। স্থূলতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ফুড ইণ্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে আইন নিয়ে ২০০৫–এ মার্কিন কংগ্রেসে আলোচনা হয়েছে ; যদিও সেটি এখনও আইন হয়নি।
ইতিহাস ও সংস্কৃতি
শব্দের বুত্পত্তি
লাতিন ওবিসিটাস শব্দ থেকে ওবিসিটি শব্দটি এসেছে। লাতিনে ওবিসিটাস-এর মানে হলো ‘মজবুত, মোটা অথবা নধর’। Ēsus হলো edere-র পাস্ট পার্টিসিপল রূপ (খেতে), সঙ্গে ob (বেশি) এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অক্সফোর্ড ডিকশনারি তে উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৬১১ নাগাদ এর প্রথম ব্যবহার করেছিলেন র্যাণ্ডেল কটগ্রেভ, এটি ব্যবহার করা হয়েছিল এ ডিকশনারি অব দ্য ফ্রেঞ্চ অ্যাণ্ড ইংলিশ টাঙস।[
ঐতিহাসিক প্রবণতা
গ্রীকরাই প্রথম স্থূলতাকে চিকিৎসা সংক্রান্ত গোলমাল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। হিপোক্রেটিস বলে গেছেন যে ‘অত্যধিক স্থূলতা কেবলমাত্র একটা রোগই নয়, বরং অন্য রোগের অগ্রদূত’’। যতদূর জানা যায় ভারতীয় শল্য চিকিৎসক সুশ্রুত (খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক)-ই ডায়াবেটিস ও হৃদযন্ত্রের গোলমালের সঙ্গে স্থূলতার যোগাযোগের কথা তুলে ধরেন। এই রোগ ও এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার চিকিৎসায় শারীরিক কসরত সাহায্য করার কথা তিনিই সুপারিশ করেন।
মানব ইতিহাসের বেশিরভাগটা জুড়েই মানবজাতিকে খাদ্যের আকালের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। এভাবে স্থূলতাকে ঐতিহাসিকভাবেই সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়ে আসছে। মধ্যযুগ ও নবজাগরণের সময় ইউরোপে উচ্চ পদস্থ আধিকারিকদের মধ্যে স্থূলতা খুবই সাধারণ বিষয় ছিল, পাশাপাশি প্রাচীন পূর্ব এশীয় সভ্যতাতেও তাই ছিল।
শিল্প বিপ্লবের প্রারম্ভিককালেও এটাই মনে করা হতো যে কোনো দেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি সেদেশের সৈন্য ও কর্মীদের আয়তন ও শক্তি উভয়ের ওপর নির্ভরশীল। গড় বডি মাস ইন্ডেক্স (BMI)কে বর্তমানে আণ্ডাওয়েট বলে বিবেচনা করা হয়, সেই গড় বি এম আই (BMI) বাড়িয়েই এখন তা একটা সাধারণ মাত্রায় পৌঁছে গেছে, যার একটা শিল্পোন্নত সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে উন্নত বিশ্বে এভাবেই উচ্চতা ও ওজন দুটোই বেড়েছে। বিংশ শতাব্দীতে জনসমষ্টি তার উচ্চতার জিনসম্বন্ধীয় সম্ভবনায় পৌঁছে যায়, কিন্তু ওজন আবার উচ্চতার তুলনায় বেশি গতিতে বাড়ে, তারই ফলাফল স্থূলতা। ১৯৫০–এর দশকে সম্পদ বাড়ার সাথে শিশুমৃত্যুর হারও কমেছে, কিন্তু শরীরের ওজন বেড়ে হৃদযন্ত্র ও কিডনির অসুখও আরো সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
এই সময় কালেই বীমা কোম্পানিগুলিও ওজন ও আয়ুর মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি ধরে ফেললো এবং ভীষণ মোটাদের প্রিমিয়ামও বাড়িয়ে দিলো্।
ইতিহাসে বহু সংস্কৃতিতেই স্থূলতাকে চারিত্রিক দোষ হিসেবে দেখা হয়ে এসেছে। গ্রিক হাস্যরসে অবিসাস অথবা মোটা মানুষের চরিত্রকে একটা পেটুক ও ব্যঙ্গবিদ্রুপের বিষয় হিসেবে দেখানো হতো। খ্রীস্টাব্দে খাবারকে আলস্য ও লালসার পাপের প্রবেশদ্বার হিসেবে দেখা হতো। আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে বাড়তি ওজনকে অনেক সময়েই অনাকর্ষী হিসেবে বিচার করা হয় এবং স্থূলতা সাধারণভাবেই বেশ কিছু নেতিবাচক একঘেয়েমির সঙ্গে জুড়ে আছে। সমস্ত বয়সের মানুষ এর জন্য সামাজিকভাবে কলঙ্কিত হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং এরা টিটকিরির শিকার হতে পারে অথবা সতীর্থরা তাকে এড়িয়ে চলতে পারে। স্থূলতা আবার বৈষম্যেরও কারণ হয়।
পাশ্চাত্য সমাজে স্বাস্থ্যবান শরীরের ওজনের সম্পর্কে জনমানসের যে ধারণা ছিল, তা আদর্শ ওজন বলা যায় যাকে তা নিয়ে ধারণা একেবারেই আলাদা ছিল— এবং বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে উভয়েরই বদল হলো। ১৯২০–র পর থেকেই যে ওজনকে আদর্শ বলা যায় তা কমতে থাকলো। দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে মিস আমেরিকা প্যাজিয়েন্ট উইনারদের বিষয়টি, ১৯২২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এই পুরস্কার বিজেতাদের গড় উচ্চতা ২% করে বেড়েছে, আবার উলটোদিকে এদের ওজন ১২%করে কমেছে। অপরদিকে, জনমানসে সুস্থ ওজন নিয়ে চিন্তা উলটোদিকে বদলে গেছে। ব্রিটেনে যে ওজন হলে মানুষ নিজেকে ওভারওয়েট মনে করবে সেই মাপকাঠিটা ১৯৯৯–এ যা ছিল ২০০৭ –এ তার তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে বেশি। মনে করা হয় এই পরিবর্তনের কারণ হলো অ্যাডিপোসিটি (মেদবহুলতা), অ্যাডিপোসিটির হার বেড়ে যাওয়ায় শরীরে অতিরিক্ত মেদকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়ার বিষয়টিও বেড়ে গেছে।
আফ্রিকার কোনো কোনো অংশে এখনও অবশ্য স্থূলতাকে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এইচ আই ভি (HIV) মহামারী শুরু হবার পর থেকে এটি বিশেষতই সাধারণ হয়ে গেছে।
চারুকলা
মানব দেহের ভাস্কর্য বিষয়ক প্রথম রূপায়ণ হয়েছিল ২০,০০০—৩৫,০০০বছর আগে, যেখানে ভীষণ মোটা এক মহিলাকে তুলে ধরা হয়েছিল। কেউ কেউ ভেনাস মূর্তিকেই মেদের বাড়বাড়ন্তের প্রবণতার জন্য দায়ী করেন, কেউ কেউ আবার মনে করেন সময়ের সাথে সাথেই মানুষের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়া বেড়ে গেছে। গ্রিক ও রোমান শিল্পকলায় যদিও অত্যধিক স্থূলতা অনুপস্থিত, এবং তা সম্ভবত সংযম বা পরিমিতির আদর্শের কারণেই। খ্রীষ্ট ইউরোপীয় ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়জুড়েই ধারবাহিকভাবে আর্থসামাজিক মর্যাদায় যারা নিচুতে তাদেরই কেমলমাত্র ভীষণ মোটা দেখানো হতো।
নবজাগরণের সময় উচ্চতর শ্রেণীর কয়েকজন তাদের নিজেদের বিরাট আকার নিয়ে সগর্বে জাহির করতে শুরু করলো, অষ্টম হেনরি ও আলেকজান্দ্রো দেল বোরোর প্রতিকৃতিতে যেমন দেখা যায়। রুবেনস (১৫৭৭–১৬৪০) নিয়মিতভাবেই তার ছবিতে পূর্ণাঙ্গ নারীদেহ ফুটিয়ে তুলতেন, সেখান থেকেই রুবেনস্কু পরিভাষাটি এসেছে। তা সত্ত্বেও সেই নারীদের যদিও তার উৎসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘আওয়ারগ্লাস’ বা বালু ঘড়ির চেহারাই থাকতো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যে স্থূলতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। স্থূলতাকেই সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদার সমার্থক হিসেবে এক শতক বিবেচনা করার পর রোগা পাতলাকেই কাঙ্খিত মাপকাঠি হিসেবে দেখা শুরু হলো।
পরিমাপের গ্রহণযোগ্যতা ও স্থূলতা বিতর্ক
অতিরিক্ত ওজন ও অতি স্থূলকায়দের সম্পর্কে যে বৈষম্য রয়েছে তা কমাতে হলে চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে, সেটাই প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। যদিও এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই স্থূলতা ও স্বাস্থ্যের নেতিবাচক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানানো যেতে পারে।
এক গুচ্ছ সংগঠন রয়েছে যারা অতি স্থূলতাকে শুধু স্বীকারই করে না বরং তাদেরকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়ে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শেষ অর্ধে এই সংগঠনের সংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে। ১৯৬৯ সালে মার্কিন সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন টু অ্যাডভান্স ফ্যাট অ্যাকসেপটেন্স (NAAFA) গঠিত হয় এবং তারা নিজেদের মানবাধিকার সংগঠন বলে দাবি করে শরীরের আয়তন বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে।
ইন্টারন্যাশনাল সাইজ অ্যাকসেপটেন্স অ্যাসোসিয়েশন (ISAA) ১৯৯৭ সালে তৈরি হয়, এটি একটি বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই সংগঠনের বিস্তার বিশ্বব্যাপী, এদের লক্ষ্য হলো মানব শরীরের যে কোনো আয়তনকে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সমাজে ওজন-ভিত্তিক যে বৈষম্য রয়েছে তা দূর করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকার প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য গৃহীত আইন (ADA) এঁদের ক্ষেত্রেও যাতে প্রযোজ্য হয় সেই দাবিতেই লড়াই করছে এই সংগঠন। আমেরিকার আইন ব্যবস্থা এনিয়ে ইতোমধ্যেই চর্চা করেছে এবং তারা এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, যদি শারীরিক বৈষম্য বিরোধী আইন অনুযায়ী স্থূলতাকে বৈধতা দেওয়া হয় তাহলে মানুষের স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ, তার সুফল সাধারণ মানুষ পাবেন না।
এনিয়ে অসংখ্য বই রয়েছে, যেমন পল ক্যাম্পোসের লেখা দ্য ডায়েট মিথ, এই বইয়ে লেখক স্থূলতার সঙ্গে স্বাস্থ্যের ঝুঁকির কোনো মিল খুঁজে পাননি, তিনি জোরের সঙ্গেই বলেছেন, স্থূলতা হলেই স্বাস্থ্যের ঝুঁকি দেখা দেবে এমন প্রামাণ্য তথ্য কেউ হাজির করতে পারেননি, তিনি সমস্যাকে সামাজিক কলঙ্ক হিসাবেই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। একইভাবে মাইকেল গার্ড তার ওবেসিটি এপিডেমিক বইয়ে স্থূলতাকে স্বাস্থ্যের অঙ্গ হিসাবে নয়, বরং একে নৈতিক ও মতাদর্শগত গঠন বলেই চিহ্নিত করেছেন। স্বাস্থ্যের কারণে স্থূলতা বাড়ে এমন যুক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আসরে রয়েছে আরো কয়েকটি সংগঠন। রেস্তোরাঁ ও খাদ্য-শিল্প সংস্থাগুলির পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে এমনই একটি সংগঠন সেন্টার ফর কনসিউমার ফ্রিডম, তারা বিজ্ঞাপনী ভাষায় প্রচার করে, স্থূলতা নিয়ে অযথা ‘উত্তেজনার পারদ’ চড়ানো হচ্ছে, এই সমস্যা কখনই মহামারীর আকার নেবে না।
একই রকম চেহারার বন্ধু বা বান্ধবী খোঁজাই সাধারণ মানুষের প্রবণতা। স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এই অংশের মানুষের কাছে সঙ্গী খুঁজে পাওয়া অনেক সুবিধাজনক হয়ে গেছে। কিছু অধঃসংস্কৃতিও পরিলক্ষিত হয়, বিশেষত স্থূলকায়দের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করার জন্য। চাবি কালচার এবং ফ্যাট অ্যাডমায়ারার হলো এর উদাহরণ।
শিশুবয়সের স্থূলতা
শিশুর বয়স ও লিঙ্গের সঙ্গে স্বুস্থ বডি মাস ইন্ডেক্স (বি এম আই BMI) ক্রমবিন্যাস ওঠানামা করে। বি এম আই (BMI)’র ৯৫তম পার্সেন্টাইলের শিশুদের ও বয়ঃসন্ধিকালের স্থূলতার সংজ্ঞা ঠিক করা হয়। উল্লেখ্যনীয় তথ্য হলো, এই পার্সেন্টাইলগুলি ভিত্তি হলো ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪–এর মধ্যবর্তী সময় এবং স্থূলতার হারের সাম্প্রতিক বৃদ্ধির দ্বারা তা প্রভাবিত হয় না। একবিংশ শতাব্দীতে শিশুবয়সের স্থূলতা মহামারীর আকার নিয়েছে, উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্ব উভয় জায়গাতেই এই হার বেড়েছে। কানাডার কিশোরদের মধ্যে স্থূলতার হার ১৯৮০–র দশকে ১১% থেকে ১৯৯০–র দশকে ৩০%–এর ওপর বেড়ে গেছে। এই একই সময়কালে ব্রাজিলের শিশুদের মধ্যে এই হার ৪ থেকে বেড়ে ১৪% হয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্কদের স্থূলতার পাশাপাশি শিশুবয়সের স্থূলতার হার বাড়ার সঙ্গে বহু বিষয় জড়িয়ে আছে। সাধারণ খাদ্য বদল ও শারীরিক কসরত কমে যাওয়াকেই সাম্র্সতিককালে এই হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে দুটি মূল কারণ বলে মনে করা হয়। কারণ শিশুবয়সের স্থূলতা বড়ো বয়সেও প্রায়ই থেকে যায় অসংখ্য কঠিন ব্যাধিকে সঙ্গী করে, যে সব শিশু ভীষণ মোটা প্রায়ই তাদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে এদের হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ), ডায়াবেটিস (মধুমেহ), হাইপারলিপিডেমিয়া ও চর্বিযুক্ত লিভার। এই সব শিশুদের চিকিৎসা হলো প্রাথমিকভাবে লাইফস্টাইল বা জীবনধারণের ধরনে হস্তক্ষেপ ও আচার আচরণ প্রণালী। এই বয়সের ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগ মোটেই এফ ডি এ (FDA) অনুমোদিত নয়।
অন্যান্য পশুর মধ্যে স্থূলতা
বহু দেশেই পোষা প্রাণীর মধ্যে স্থূলতা খুবই সাধারণ বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কুকুরদের মধ্যে অত্যধিক ওজন ও অতিশয় স্থূলতার হার ২৩শতাংশ থেকে ৪১%, এর মধ্যে প্রায় ৫.১% ভীষণ মোটা। বিড়ালদের মধ্যে স্থূলতার হার ৬.৪%’এর থেকে সামান্য বেশি। পশুরোগ বিষয়ক তথ্যের নিরিখে অস্রেহালিয়ায় কুকুরদের মধ্যে স্থূলতার হার দেখা যায় ৭.৬%। তাদের মালিক ভীষণ মোটা কি না তার ওপর কুকুরদের স্থূলতার ঝুঁকি থাকলেও বিড়ালদের স্থূলতার কোনো সম্পর্ক নেই।
উদ্ধৃতি
গ্রন্থপঞ্জী
- Bhargava, Alok; Guthrie, J. (২০০২)। "Unhealthy eating habits, physical exercise and macronutrient intakes are predictors of anthropometric indicators in the Women's Health Trial: Feasibility Study in Minority Populations"। British Journal of Nutrition। 88 (6): 719–728। ডিওআই:10.1079/BJN2002739। পিএমআইডি 12493094।
- Bhargava, Alok (২০০৬)। "Fiber intakes and anthropometric measures are predictors of circulating hormone, triglyceride, and cholesterol concentration in the Women's Health Trial"। Journal of Nutrition। 136 (8): 2249–2254। পিএমআইডি 16857849।
- Jebb S. and Wells J. Measuring body composition in adults and children In:Peter G. Kopelman, Ian D. Caterson, Michael J. Stock, William H. Dietz (২০০৫)। Clinical obesity in adults and children: In Adults and Children। Blackwell Publishing। পৃষ্ঠা 12–28। আইএসবিএন 140-511672-2। উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: লেখকগণের তালিকা (link)
- Kopelman P., Caterson I. An overview of obesity management In:Peter G. Kopelman, Ian D. Caterson, Michael J. Stock, William H. Dietz (২০০৫)। Clinical obesity in adults and children: In Adults and Children। Blackwell Publishing। পৃষ্ঠা 319–326। আইএসবিএন 140-511672-2। উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: লেখকগণের তালিকা (link)
- National Heart, Lung, and Blood Institute (NHLBI) (১৯৯৮)। Clinical Guidelines on the Identification, Evaluation, and Treatment of Overweight and Obesity in Adults (PDF)। International Medical Publishing, Inc। আইএসবিএন 1-58808-002-1। উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: লেখকগণের তালিকা (link)
- "Obesity: guidance on the prevention, identification, assessment and management of overweight and obesity in adults and children" (pdf)। National Institute for Health and Clinical Excellence(NICE)। National Health Services (NHS)। ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ৮, ২০০৯।
- Puhl R., Henderson K., and Brownell K. Social consequences of obesity In:Peter G. Kopelman, Ian D. Caterson, Michael J. Stock, William H. Dietz (২০০৫)। Clinical obesity in adults and children: In Adults and Children। Blackwell Publishing। পৃষ্ঠা 29–45। আইএসবিএন 140-511672-2। উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: লেখকগণের তালিকা (link)
- Seidell JC. Epidemiology — definition and classification of obesity In:Peter G. Kopelman, Ian D. Caterson, Michael J. Stock, William H. Dietz (২০০৫)। Clinical obesity in adults and children: In Adults and Children। Blackwell Publishing। পৃষ্ঠা 3–11। আইএসবিএন 140-511672-2। উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: লেখকগণের তালিকা (link)
- World Health Organization (WHO) (২০০০)। Technical report series 894: Obesity: Preventing and managing the global epidemic. (পিডিএফ)। Geneva: World Health Organization। আইএসবিএন 92-4-120894-5। ১ মে ২০১৫ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ ফেব্রুয়ারি ২০১১।
- Fumento, Michael (১৯৯৭)। The Fat of the Land: Our Health Crises and How Overweight Americans can Help Themselves। New York: Penguin Books। আইএসবিএন 0-140261443।
- Keller, Kathleen (২০০৮)। Encyclopedia of Obesity। Thousand Oaks, Calif: Sage Publications, Inc। আইএসবিএন 1-4129-5238-7।
- Kolata, Gina (২০০৭)। Rethinking Thin: The new science of weight loss – and the myths and realities of dieting। Picador। আইএসবিএন 0-312-42785-9।
- Kopelman, Peter G. (২০০৫)। Clinical obesity in adults and children: In Adults and Children। Blackwell Publishing। পৃষ্ঠা 493। আইএসবিএন 140-511672-2।
- Levy-Navarro, Elena (২০০৮)। The Culture of Obesity in Early and Late Modernity। Palgrave Macmillan। আইএসবিএন 0230601235।
- Pool, Robert (২০০১)। Fat: Fighting the Obesity Epidemic। Oxford, UK: Oxford University Press। আইএসবিএন 0-19-511853-7।
বহিঃসংযোগ
- World Health Organization – Obesity pages
- Diet, Nutrition and the prevention of chronic diseases (including obesity) by a Joint WHO/FAO Expert consultation (2003).
- Obesity at Endotext.org
- International Task Force on Obesity
- Obesity at the Centers for Disease Control (USA)
- The Obesity Society (USA)
- National Obesity Forum (UK)
- Australasian Society for the Study of Obesity
Hypoalimentation/ malnutrition |
|
||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
Hyperalimentation |
|
||||||||||
| |||||||||||||||||||||||
খাদ্যসংযম অভ্যাস |
|
||||||||||||||||||||||
পুষ্টি |
|
||||||||||||||||||||||
খাদ্যাভ্যাস-সংক্রান্ত পরামর্শ |
|||||||||||||||||||||||
জাতীয় গ্রন্থাগার | |
---|---|
অন্যান্য |