অ্যান্টার্কটিকায় অপরাধ
অ্যান্টার্কটিকায় অপরাধ আপেক্ষিকভাবে খুবই কম। তবে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও একঘেয়ে জীবনের নেতিবাচক প্রভাবে কোনও কোনও ব্যক্তির মধ্যে অপরাধপ্রবণতা জেগে উঠতে পারে।মদ্যাসক্তি এই মহাদেশের অধিবাসীদের একটি পরিচিত সমস্যা। এর ফলে মাঝে মাঝে মারামারি বা অন্যান্য অশালীন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। অন্যান্য অপরাধগুলির মধ্যে বেআইনি ড্রাগ ব্যবহার, বন্যপ্রাণীদের উপর অত্যাচার ও হত্যা, পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকায় মোটরবাইক রেসিং, মারণাস্ত্র সহ হামলা, হত্যার চেষ্টা ও ইচ্ছাকৃত বা অবৈধভাবে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যৌন অপরাধের ঘটনার কথাও জানা যায়।
অ্যান্টার্কটিকায় নগদ অর্থের ব্যবহার খুব কম হয়। এছাড়া এখানে অধিবাসীরা বেশি কিছু নিয়েও আসতে পারে না। তাই ডাকাতির ঘটনা অ্যান্টার্কটিকায় নগন্য।
৫৩টি রাষ্ট্র কর্তৃক অনুসমর্থিত ১৯৫৯ সালের অ্যান্টার্কটিক চুক্তি অনুযায়ী, অ্যান্টার্কটিকায় কোনও ধরনের অপরাধমূলক ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব তার নিজের দেশের কর্তৃপক্ষের।
অ্যান্টার্কটিকায় অপরাধদমনে প্রযুক্ত জাতীয় আইন
দক্ষিণ আফ্রিকা
অ্যান্টার্কটিকার দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিকেরা ‘সাউথ আফ্রিকান সিটিজেন্স ইন অ্যান্টার্কটিকা অ্যাক্ট, ১৯৬২’-এর বলে দক্ষিণ আফ্রিকান আইন কর্তৃক শাসিত হন। এই আইন অনুযায়ী, অ্যান্টার্কটিকা কেপ টাউনে অবস্থিত ম্যাজিস্ট্রেট’স কোর্টের অধীনস্থ বলে পরিগণিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
কম্প্রিহেনসিভ ক্রাইম কন্ট্রোল অ্যাক্ট, ১৯৮৪ (১৯৮৪ সালের ১২ অক্টোবর বিধিবদ্ধ) অনুযায়ী মার্কিন নাগরিকদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ অথবা মার্কিন নাগরিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কিন্তু অন্য কোনও দেশে থাকেন না, এমন মার্কিন নাগরিকেরাও কয়েকটি মার্কিন আইনের আওতাভুক্ত। অপরাধে অভিযুক্ত কোনও মার্কিন নাগরিক এবং কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্রের বাইরে কোনও মার্কিন নাগরিকের বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত কোনও বিদেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের বিচারাধীন। উক্ত অঞ্চলের মধ্যে আন্তর্জাতিক জলক্ষেত্র ও অ্যান্টার্কটিকাও পড়ে। বিভিন্ন রাষ্ট্র অ্যান্টার্কটিকার অঞ্চল দাবি করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সব দাবি স্বীকার করে না।
১৯৮৪ সালের কম্প্রিহেনসিভ ক্রাইম কন্ট্রোল অ্যাক্ট অনুযায়ী, অপরাধের উদাহরণগুলি হল নরহত্যা, আঘাত করা, ধর্ষণ, ইচ্ছাকৃত বা অবৈধ অগ্নিসংযোগ, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় আধিকারিককে ঘুষ দেওয়া।
অ্যান্টার্কটিকায় সংঘটিত অপরাধগুলির তালিকা
১৯৫৯ – ১৯৫৯ সালে প্রিন্সেস এলিজাবেথ ল্যান্ডে অবস্থিত তদনীন্তন সোভিয়েত রিসার্চ স্টেশন ভস্তকে দাবা খেলাকে কেন্দ্র করে দুই বিজ্ঞানীর মধ্যে সংঘাত বাধে। তাঁদের একজন খেলায় হেরে যাওয়ায় এতটাই রেগে যান যে অপর জনকে একটি আইস অ্যাক্স নিয়ে আক্রমণ করে অসেন। কোনও কোনও সূত্র অনুযায়ী, আক্রান্ত বিজ্ঞানীর মৃত্যু ঘটেছিল। যদিও অন্যান্য সূত্রের মতে, আঘাত মারাত্মক ছিল না। পরবর্তীকালে সোভিয়েত/রাশিয়ান অ্যান্টার্কটিক স্টেশনগুলিতে দাবা খেলা নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
অক্টোবর, ১৯৮১ – ম্যাকমার্ডো সাউন্ডে অবস্থিত মার্কিন গবেষণা কেন্দ্র ম্যাকমার্ডো স্টেশনের একটি চ্যাপেলে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করা হয়। উইন্টার-ওভার রোগাক্রান্ত এক ক্রিউ সদস্য শীতে তাড়াতাড়ি ছুটি পাওয়ার জন্য মত্ত অবস্থায় গভীর রাতে সেই চ্যাপেলে আগুন লাগিয়ে দেন। চ্যাপেল থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করলে তা কোনও এক ব্যক্তির চোখে পড়ে এবং দমকলে খবর দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি অগ্নিকাণ্ডের খবর দিয়েছিলেন বলে জানা যায়, তিনিই ভিতরে গিয়ে আসনকে আগুনের হাত থেকে রক্ষা করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর এক বন্ধু এসে উপস্থিত হয় এবং দু’জনে মিলে দমকল কর্মীরা আসার আগেই জ্বলন্ত গালিচাটিকে দরজার বাইরে এনে ফেলেন। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ হয়নি এবং চ্যাপেলটিকেও পরবর্তী গ্রীষ্মে মেরামত করা হয়।
১২ এপ্রিল, ১৯৮৪ – অ্যালমাইরান্তে ব্রাউন স্টেশন হল প্যারাডাইস হারবারের ধারে কট্রে উপদ্বীপে অবস্থিত একটি আর্জেন্টিনীয় গবেষণা কেন্দ্র। স্টেশনের নেতা ও ডাক্তারকে শীতে অ্যান্টার্কটিকায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া হলে ১৯৮৪ সালের ১২ এপ্রিল তিনি স্টেশনের মূল যন্ত্রপাতি ও ভবনটিতে আগুন লাগিয়ে দেন। স্টেশনের কর্মচারীদের হিরো নামে একটি জাহাজ উদ্ধার করে নিয়ে যায় অ্যানভারস দ্বীপের মার্কিন গবেষণা কেন্দ্র পামার স্টেশনে। দু’টি স্টেশন আকাশপথে প্রায় ৫৮ কিলোমিটার (৩৬ মাইল) দূরে অবস্থিত ছিল।
৯ অক্টোবর, ১৯৯৬ – ম্যাকমার্ডো স্টেশনের রান্নাঘরে দুই কর্মীর মধ্যে একটি মারামারির ঘটনা ঘটে। তাদের একজন অপর জনকে হাতুড়ি নিয়ে আক্রমণ করে। অপর এক পাচকও তাদের হাতাহাতি থামাতে গিয়ে আহত হয়। আক্রান্ত দুই ব্যক্তির নাম ছিল টনি বেয়ার ও জো স্টারমার। দু’জনেরই ক্ষতস্থান সেলাই করতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফবিআই এজেন্টরা ম্যাকমার্ডো স্টেশনে আসেন তদন্ত ও অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে। সন্দেহভাজন ব্যক্তি হাওয়াইয়ের হোনোলুলুতে পালিয়ে যান। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে বিপজ্জনক অস্ত্র নিয়ে চার বার আঘাতের অভিযোগ আনা হয়। আদালতে সে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছিল। এই ব্যাপারে আর কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।
১১ মে, ২০০০ – দক্ষিণ মেরুর মার্কিন গবেষণা কেন্দ্র অ্যামান্ডসেন-স্কট সাউথ পোল স্টেশনে অস্ট্রেলিয়ান জ্যোতির্পদার্থবিদ রোডনি মার্কস জ্বর, পেটের ব্যথা ও বমি ভাবে আক্রান্ত হন। ১২ মে তাঁর মৃত্যু ঘটে। সেই সময় তাঁর মৃত্যুটিকে স্বাভাবিক মৃত্যুই মনে করা হয়েছিল। শীতের প্রাক্কালে মৃত্যু হয় বলে তাঁর দেহ ছয় মাসের আগে সরানো যায়নি। সেটিকে মানমন্দিরেই একটি ফ্রিজারে রেখে দেওয়া হয়। ছয় মাস পরে তাঁর দেহ অটোপসির জন্য নিয়ে আসা হয় নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে। অটোপসি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তাঁকে মিথানল বিষে তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল। কীভাবে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল তা রহস্যই থেকে যায়।
৯ অক্টোবর, ২০১৮ – কিং জর্জ দ্বীপে অবস্থিত রাশিয়ান গবেষণা কেন্দ্র বেলিংশসেন স্টেশনে একটি ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত ব্যক্তিটি ছিলেন সার্জি সাভিৎস্কি নামে চুয়ান্ন বছর বয়সী এক ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর বিরুদ্ধে ওলেগ বেলোগুজভ নামে এক বাহান্ন বছর বয়সী ঢালাইকারকে বুকে একাধিকবার ছুরিকাঘাতের অভিযোগ ওঠে। কয়েকটি সূত্রের মতে, স্টেশনের গ্রন্থাগারে সাভিৎস্কি যে বইগুলি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন, সেগুলির শেষাংশ বেলোগুজোভ বিতরণ করে দিচ্ছিলেন বলে সাভিৎস্কি তাঁকে ছুরিকাঘাত করেন। অন্য সূত্রের মতে, খাবার ঘরে এই ঘটনা ঘটেছিল। বেলোগুজোভ ঠাট্টা করে সাভিৎস্কিকে টেবিলের উপর নেচে অর্থোপার্জন করার কথা বললে সাভিৎস্কি রেগে তাঁকে আক্রমণ করেন। দু’টি সূত্র থেকেই জানা যায় যে, সাভিৎস্কি সেই সময় মত্ত অবস্থায় ছিলেন। তাঁরা দু’জনে ছয় মাস সেই স্টেশনে একসঙ্গে কাজ করছিলেন। সাভিৎস্কি সম্ভবত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। এক স্থানে বদ্ধ অবস্থায় কাটানোর জন্য এই রকম অবসাদের জন্ম হয়েছিল। তাঁদের দু’জনেই তার আগের কয়েক মাস নানা সমস্যায় বিব্রত ছিলেন। বেলোগুজোভকে চিলির একটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সাভিৎস্কি স্টেশনের ম্যানেজারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ১১ দিন বাদে তাঁকে রাশিয়াগামী একটি বিমানে তুলে দেওয়া হয়। দেশে ফেরানোর পর ৮ অথবা ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল।