Мы используем файлы cookie.
Продолжая использовать сайт, вы даете свое согласие на работу с этими файлами.

ডেভিড লিভিংস্টোন

Подписчиков: 0, рейтинг: 0
ডেভিড লিভিংস্টোন
David Livingstone -1.jpg
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে লিভিংস্টোন
জন্ম (১৮১৩-০৩-১৯)১৯ মার্চ ১৮১৩
ব্লানটায়ার, সাউথ ল্যানার্কশায়ার,স্কটল্যান্ড
মৃত্যু ১ মে ১৮৭৩(1873-05-01) (বয়স ৬০)
চিফ চিতম্বোর গ্রাম কাজাম্বির রাজ্য বর্তমানে জাম্বিয়া
সমাধি ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে
৫১°২৯′৫৮″ উত্তর ০°০৭′৩৯″ পশ্চিম / ৫১.৪৯৯৪৪৪° উত্তর ০.১২৭৫° পশ্চিম / 51.499444; -0.1275
পরিচিতির কারণ সুসমাচার প্রচারক আফ্রিকা অভিযাত্রী
দাম্পত্য সঙ্গী মেরি মোফাত (বি.১৮৪৫,মৃ.১৮৬২)
সন্তান

ডেভিড লিভিংস্টোন (১৯ মার্চ, ১৮১৩ - ১ মে, ১৮৭৩) ছিলেন একজন স্কটিশ চিকিৎসক, লন্ডন মিশনারি সোসাইটির অন্যতম ধর্মপ্রচারক এবং আফ্রিকায় মহান মানবতাবাদী অভিযাত্রী। তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন আফ্রিকা মহাদেশের সন্ধান দিয়ে, আদিম অধিবাসী অধ্যুষিত দুর্গম অঞ্চলে পাশ্চাত্য সভ্যতার আলোক পৌঁছে দিয়ে, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে যথার্থ বৃটিশ বীরের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তার মিশনারির কাজে, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিষ্ণু মনে এগিয়ে চলার পথে, সংস্কারের ভূমিকায়, দাসত্ববিরোধী ক্রিয়াকলাপে, বৃটিশের বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তারের প্রতিটি প্রয়াস পৌরাণিক কাহিনীতে স্থান করে নিয়েছে।  

তার কর্মভূমি আফ্রিকার আদিম অরণ্য তাঁকে হাতছানি দিত। তাই বেরিয়ে পড়তেন অসীম সাহসে। চলার পথে আবিষ্কার করেন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত, প্রত্যক্ষ করেছেন ঘৃণিত দাস ব্যবসায় মানুষের অমানবিক আচরণ। পাশবিক ব্যবসা বন্ধ করার প্রভূত চেষ্টার মাঝে নীলনদের উৎসস্থলে পৌঁছাতে চেয়ে নিজের জীবনীশক্তি হারিয়ে মহান মানবতাবাদী অভিযাত্রী  ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে হলেন মরণোত্তর জাতীয় বীর।

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

লিভিংস্টোন এর জন্মস্থান ব্লান্টায়ারে
ডেভিড লিভিংস্টোন এর জন্মস্থান, পিরিয়ড গৃহসজ্জা সহ

লিভিংস্টোন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে মার্চ স্কটল্যান্ডের সুতো-মিলের শহর ল্যানার্কশায়ারের ব্লানটায়ারের ক্লাইড নদীর তীরে বোথওয়েল ব্রিজের শেষে সুতো কারখানার শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি তার পিতা নীল লিভিংস্টোন (১৭৮৮ - ১৮৫৬) ও মাতা অ্যাগনেসের (১৭৮২ - ১৮৬৫) সাতটি সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। তার পিতার ছিল খুচরো চায়ের ব্যবসা এবং খ্রীষ্ট ধর্মীয় "সান্ডে স্কুলে" শিক্ষকতা করতেন। পাশাপাশি মিশনারির কাজ করতেন, ধর্মের প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ ও বিশ্বাস। লিভিংস্টোন ছোটবেলা থেকেই ধর্মপ্রাণ পিতার কাছ থেকে ঈশ্বর বিশ্বাসের অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন; কিন্তু তার মধ্যে কোন ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। তার ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিশে ছিল বিজ্ঞান চেতনা।

সাংসারিক প্রয়োজনে দশ বৎসর বয়সে সাউথ ল্যানার্কশায়ারের ব্লানটায়ারের  হেনরি মনটিয়েথ অ্যান্ড কোম্পানির সুতো কারখানায় কাজ নেন। তিনি ও তার এক ভাই জন বারো ঘণ্টা স্পিনিং মেশিনে কঠোর পরিশ্রমের  কাজ করতেন। কিন্তু তার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল এমন গভীর যে, দৈনিক বারো ঘণ্টা পরিশ্রমের ফাঁকে প্রকৃতি ঔ বিজ্ঞান বিষয়ের বই পড়তেন। ডেভিডের সবচেয়ে প্রিয় ছিল ভ্রমণকাহিনী। সেসব কাহিনীর মধ্যে নানা দেশে তার মন ঘুরে বেড়াত। এক সময় এক জার্মান মিশনারি র লেখা বই পড়ে মিশনারি জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু পিতার ধর্মীয় উন্মাদনাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেনি লিভিংস্টোন। মনের মধ্যে গভীর সংশয় আর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হল। তবে এর মধ্যে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে টমাস ডিকের লেখা ফিলজফি অফ এ ফিউচার স্টেট" বই পড়ে ফেলেছেন। তার চেতনার উন্মেষ হল -  ধর্ম এবং বিজ্ঞান কেউ পরস্পরের বিরোধী নয়। উভয়ের পরিপূরক। বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে যদি ধর্মের সাধনা করা যায় তবে সেখানে কোন গোঁড়ামি, ধর্মীয় উন্মাদনা প্রবল হয়ে উঠতে পারে না। তখনই তিনি মিশনারি জীবন গ্রহণ করেন।

শিক্ষা জীবন

লিভিংস্টোন ব্রানটায়ারের গ্রামের স্কুলে অন্যান্য মিলের কর্মচারীদের সন্তানদের সাথে পড়াশোনা শুরু করছিলেন। পরে এক ভাই ও পিতার উৎসাহে ২৩ বৎসর বয়সে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে  ডেভিড গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হন। এখানে তার পাঠ্য বিষয় ছিল ধর্মশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র ও গ্রিক ভাষা সাহিত্য।

এক বছর পর তিনি লন্ডনের মিশনারি সোসাইটিতে শিক্ষানবিশি শুরু করেন। কিন্তু ধর্মপ্রচারকের কাজের মধ্যে মনোনিবেশ করা সম্ভব হল না। কিছুদিনের মধ্যে মিশনারি সোসাইটি ছেড়ে চিকিৎসাবিদ্যা শেখার কাজে ভর্তি হলেন। লন্ডনের বিভিন্ন হাসপাতালে দুবছর শিক্ষানবিশি করার পর তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে চিকিৎসকের চাকরি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার পথে যাত্রা করেন।

আফ্রিকার জন্য জীবনপাত

জুলু নৃত্য, লিভিংস্টোন-এর ন্যারেটিভ অফ আ অভিযান থেকে জাম্বেসি এবং এর উপনদীগুলিতে

লিভিংস্টোনের প্রথমদিকে ইচ্ছা ছিল সুদূর চীন দেশে পাড়ি জমানোর। কিন্তু ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের প্রথম আফিম যুদ্ধের কারণে তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি, তাঁকে যেতে হল অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে। দীর্ঘসমুদ্র যাত্রায় ক্যাপ্টেনের  সাথে বন্ধুত্ব করে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র দেখে দিক নির্ণয় করার বিদ্যা রপ্ত করেছিলেন, যা পরবর্তীতে তার  বিভিন্ন অভিযানে সহায়ক হয়েছিল। তার সমুদ্র পথের যাত্রা শেষ হয় আলগোয়ায়। সেখান থেকে ৭০০ মাইল দূরত্বের বন্ধুর, জঙ্গলাকীর্ণ পথ বহুকষ্টে কখনো হেঁটে, বলদের পিঠে চড়ে গন্তব্য মিশনারি সংস্থার প্রধান কার্যালয় কুরুমানে পৌঁছান ধর্মযাজক-চিকিৎসক লিভিংস্টোন। সেখানকার বিভিন্ন স্থানে অরণ্যবাসী মানুষের চিকিৎসার সঙ্গে চালাতেন ধর্মপ্রচার, ধর্মান্তরকরণ। শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি এমনি সব অঞ্চলে পরিক্রমা করে, চিকিৎসাসেবা দিয়ে কাটিয়ে দেন সুদীর্ঘ ১১টি বছর। ইতিমধ্যে কুরুমান মিশনারি সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা ড. রবার্ট মোফাতের একমাত্র কন্যা মেরিকে ভালবেসে বিবাহ করেন এবং কুরুমান হতে ২০০ কিমি দূরে মাবেস্তায় বসবাস শুরু করেন। এই সময়ের মধ্যে  আফ্রিকার নানা ভাষা শিখে ফেললেন, সেখানকার লোকেদের সঙ্গে মিশে তাদের সুখ-দুঃখের কথা সব জানলেন,পর্তুগীজ আর আরব দস্যুরা তাঁদের ধরে নিয়ে দাস করে রাখে, ছাগল গরুর মতো হাটে বাজারে বিক্রি করে —আর দেশটাকে তার এত ভাল লাগল যে,  ধর্মপ্রচারের সাথে তাদের সেবায় জীবনপাত করতে তিনি প্রস্তুত হলেন।  ধর্মপ্রচারের  জন্য নতুন  এলাকা অনুসন্ধানের জন্য তিনি মাঝে মাঝে উত্তর দিশায় যাত্রা করতেন। স্থানীয় অধিবাসীদের চাষবাসের জীবিকায় তাদের শেখালেন জলসেচের উপায় আর উন্নত কৃষিপ্রণালী । বিপদসঙ্কুল পরিবেশে স্ত্রীকে রেখে স্থানীয় আস্থাভাজন আদিবাসীদের নিয়ে ছোটখাট ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়তেন। এমনি এক অভিযান থেকে একবার বাড়ি ফিরছেন, সঙ্গীসাথীদের পেছনে রেখে যখন তিনি সামনে চলেছেন, সহসা জঙ্গল থেকে এক সিংহ তার সামনে এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক তুলে গুলি করেন। কিন্তু সামান্য আঘাত পেয়ে সিংহ ঝাঁপিয়ে পড়ে লিভিংস্টোনের ওপর। তার বাঁ হাতের মাংস ঝুলে পড়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে পেছনের লোকজন এসে পড়ায় ভয়ে সিংহ পালিয়ে গেল। কয়েকমাসের সেবাশুশ্রূষায় তিনি সুস্থ হলেন  বটে, কিন্তু বাঁ হাতটি  তার চিরদিনের মত কমজোরি হয়ে যায়। লিভিংস্টোন আসলে সিংহটিকে গুলি করেছিলেন, এমনি ভেবে যে, অন্যেরা ভয় পেয়ে যাবে আর তারা স্থানীয় গ্রামবাসীদের পালিত গোসম্পদ, ভেঁড়া ইত্যাদি  পশুদের আর ক্ষতি করবে না।

এ ভাবে ধীরে ধীরে তার ভেতরে ভ্রমণের এক উদগ্র নেশার উদ্রেক হয়। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে সেই নেশাকে আরো বেশি তীব্র করে তোলে মধ্য আফ্রিকায় অবস্থিত এক  হ্রদের গল্প এবং মাকোলোলো জাতির সর্দার সেবিচুয়েনের সাথে দেখা করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। লিভিংস্টোন অজানা পথের ডাকে হয়ে ওঠেন দিশেহারা। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তরের অনাবিষ্কৃত অঞ্চল খুঁজে বের করতে পৌঁছে গেলেন জনমানবহীন  কালাহারি মরুভূমির প্রান্তে। পথের সমস্ত প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে, অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন নাগানি হ্রদে।

দক্ষিণ এবং মধ্য আফ্রিকা অভিযান

লিভিংস্টোন আফ্রিকার যাত্রা ১৮৫১খ্রি. এবং ১৮৭৩ খ্রি. এর মধ্যে

মিশনারির কাজকর্মে বেশিদিন এক জায়গায় বসবাস সম্ভব হত না তার। ইতিমধ্যে মাবেস্তা ত্যাগ করে বোবেঙ্গ নদীর তীরে কোবেঙ্গে বাস করছিলেন, কিন্তু পরের বছরেই স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে অজানা অঞ্চলের সন্ধানে বের হলেন। বিষাক্ত মাছির দংশনে ছেলেমেয়েরা অসুস্থ হলে জঙ্গলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছেড়ে চলে যান কেপটাউন। নানা সমস্যা বিবেচনা করে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের জাহাজে করে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। কেপটাউন হতে যখন ফিরলেন কোবেঙ্গের বাড়িতে, তখন দেখলেন সাম্প্রদায়িক বিবাদে  গ্রাম অগ্নিদগ্ধে ধ্বংস হয়েছে,  নিজের মূল্যবান বইপত্র ও প্রয়োজনীয় ওষুধ ইত্যাদি লুঠেরা নষ্ট করেছে। অসীম মনোবল নিয়ে সর্বস্বান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লিভিংস্টোন নতুন করে গ্রাম পুনর্গঠন করলেন। তার  আগে ব্যর্থ হওয়া জাম্বেসির পথে অভিযান নতুন করে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে শুরু করে জাম্বেসির উত্তর প্রান্তে পৌঁছলেন। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় বিশেষ জনবসতি না পাওয়ায় নতুন মিশন স্থাপন সম্ভব হল না। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই নভেম্বর নতুন অভিযান শুরু করলেন পশ্চিম উপকূলে পৌঁছাবার সহজ পথ খুঁজে বের করতে। ২৭ জন আদিবাসী সঙ্গী নিয়ে দুর্ধর্ষ এক বন্য উপজাতি এলাকার মধ্য দিয়ে যেতে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়লেন। আদিবাসী অনুচররা অধৈর্য হয়ে সরাসরি বিদ্রোহ প্রকাশ করল। এমন প্রাণসংশয়ের মত অবস্থায় নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে অসীম সাহস আর মনোবলে একসময় এসে পৌঁছলেন অ্যাঙ্গোলায় । সেখানে পর্তুগিজ সেনাবাহিনীর ছাউনি থেকে পথনির্দেশ পেয়ে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে মে উপস্থিত হলেন সমুদ্রতীরের সাও পাওলো দ্য লুয়ান্ডায়। এভাবেই তিনি সমুদ্র উপকূলে পৌঁছাবার সহজতম পথ খুঁজে পেলেন। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডে ফেরার আহ্বান পেয়ে দেশে ফেরার আনন্দে যে পথে এসেছিলেন সে পথ ধরে পায়ে হেঁটে অথবা বলদে চেপে পৌঁছলেন লিয়ান্টিতে। এই অভিযানে লিভিংস্টোন গোটা আফ্রিকা মহাদেশ পাড়ি দেন। পথের মধ্যে স্থানীয় সঙ্গীদের পরামর্শে তিনি মোসি-ওয়া-তুনিয়া অর্থাৎ  'ধোঁয়া-গর্জনের পাহাড়'  দর্শনে যান।  তিনি দেখলেন,  জাম্বেসি নদীটা একটা পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে ঢুকে পাহাড়ের পেট কেটে তিনশ হাত খাড়া ঝরনার মতো ঝরে পড়ছে। এত বড় ঝরনা লিভিংস্টোন কোনদিন দেখেননি। পড়বার বেগে ঝরনার জল ভয়ানক শব্দে ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে প্রায় ২০০ হাত উঁচু হয়ে উঠছে—তার উপর সূর্যের আলো পড়ে চমৎকার রামধনুর ছটা বের হচ্ছে — আর সেই ঝাপসা ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে রংবেরঙের গাছপালা পাহাড় জঙ্গল দেখা যাচ্ছে, ঠিক যেন ছিটের পর্দা।আবিষ্কৃত হল পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ জলপ্রপাত ভিক্টোরিয়া

এই সময়ে তিনি এক অঞ্চলে পৌঁছে জলার গভীর পাঁকে আটকে  গিয়েছিলেন, শুধু ভাগ্যক্রমে এক সঙ্গীর সহায়তায় বেঁচে যান। স্ত্রী পুত্র ও স্বদেশের টানে ইংল্যান্ড ফিরে আসেন। অজানা মহাদেশ আফ্রিকা আবিষ্কারের জন্য সংবর্ধনা পেলেন। রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটি সম্মান জানাল ভিক্টোরিয়া পদক দিয়ে। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করে সাম্মানিক ডিগ্রি। আফ্রিকা অভিযান তথা ভ্রমণের অভিজ্ঞতার বিবরণ নিয়মিত ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করতেন। এবার সেটি বর্ণনা করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে গঠিত হল অভিযাত্রী মিশন। লন্ডন মিশনারি সোসাইটির কাজ ছেড়ে অভিযাত্রী মিশনের কাজে এবার ভাই জনকে নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করেন জাম্বেসি অভিযানে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে। উদ্দেশ্য জাম্বেসি নদীপথে বাণিজ্য বিস্তারের সম্ভাব্য দিক খতিয়ে দেখা আর দাস ব্যবসা বিলোপের উপায় খোঁজা। কিন্তু এবার ভাগ্য বিরূপ ছিল। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে পত্নী মেরি তার কাছে যান এবং অল্পকাল পরেই চুপাঙ্গা গ্রাম ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে  ২৭ শে এপ্রিল মেরির  মৃত্যু হয। পত্নী মেরির মৃত্যুতে  মুহ্যমান লিভিংস্টোন কিছু দিন গৃহবন্দি থেকে নতুন উদ্যমে আবিষ্কার করলেন ইউরোপীয়দের অজানা  দুটি হ্রদ - নিয়ামা ও বাঙ্গোয়েন। ফেরার পথে নিজের তৈরি ডিঙিতে ভাসলেন। আফ্রিকার সমুদ্র উপকূল থেকে এসে পৌঁছালেন ইংরাজদের বৃহত্তম উপনিবেশ ভারতবর্ষে। দেশটা ঘুরে ঘুরে দেখার ইচ্ছা অপূর্ণ রেখে ইংল্যান্ড ফিরে গেলেন ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে।

নীল নদের উৎস

জাম্বেসি অভিযানের কাহিনী লেখা শেষ করে প্রকাশের ব্যবস্থা করে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ৫০ বৎসর বয়সে তিনি শেষবারের মতো নীলনদের উৎসস্থলে পৌঁছানোর জন্য বের হলেন। সঙ্গী-সাথী জুটিয়ে বেরোলেন, কিন্তু প্রথম থেকেই বাধা-বিঘ্ন উপস্থিত হতে লাগল। পথের কষ্টে অনেকে ছেড়ে গেল। তারা রটিয়ে দিল লিভিংস্টোনকে হত্যা করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে কোন খবর পাওয়া যায় নি। ক্রমে দেশবাসী লিভিংস্টোনের কি ঘটেছে জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠল। এদিকে তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করে অসুস্থ শরীরে পৌঁছেছেন  বিশাল এক হ্রদের কাছে, নাম ট্যাঙ্গানিকা। তখন তার চলার শক্তি পর্যন্ত ছিল না। সেখানে এক দল আরব অবশ্য তাকে সুস্থ করে তুলেছিল।

দক্ষিণ তানজানিয়ায় মিকিন্ডানির এই বাড়িটি লিভিংস্টোনের শেষ অভিযানের সূচনা পয়েন্ট ছিল। তিনি ২৪ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত এখানে অবস্থান করেছিলেন।

স্ট্যানলির সাক্ষাৎ

উজিজির লিভিংস্টোন স্মৃতি ভাস্কর্য
হেনরি মরটন স্ট্যানলির সাথে ডেভিড লিভিংস্টোন
Livingstone Memorial in Ujiji, Tanzania
জিম্বাবুয়ের পাশে প্রথম মূর্তি ভিক্টোরিয়া ফলসে ডেভিড লিভিংস্টোন স্মৃতিসৌধ

দেশের মানুষের হয়ে স্ট্যানলি নামের এক ওয়েল শ যুবক তার সংবাদ নিতে আফ্রিকায় আসলেন। তিনি বছর খানেক বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে লিভিংস্টোনের সাক্ষাৎ পান  আরবদের তাঁবুতে। বিধ্বস্ত শীর্ণ চেহারা। দুজনে একই তাঁবুতে থেকে, সেবা-শুশ্রূষায় অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন লিভিংস্টোন। দেশে ফিরতে চাইলেন না। তিনি বললেন -

"আমি এই দেশের নির্জন নিস্তব্ধ জঙ্গলের মধ্যেই এ জীবন শেষ করব।"

স্ট্যানলি  বিদায় নেওয়ার  আগে তার অভিযানের উপযুক্ত কুলি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জোগাড় করে দিয়ে গেলেন।

জীবনাবসান

ডেভিড লিভিংস্টোন পদক

লিভিংস্টোন অভিযানের দিনগুলিতে প্রতিদিন নিয়ম করে ডায়েরি লিখতেন। তার জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে এসেছিল। তখন তিনি বর্তমান জাম্বিয়া অঞ্চলে তৎকালীন চিতাম্বো গ্রামে অবস্থান করছিলেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে এপ্রিলের পর তিনি ডায়েরি লিখতে পারেন নি। ১ লা মে ভোরবেলা তার প্রিয় নিগ্রো চাকর জেমস চুমা ও আবদুল্লা সুসি দেখল - বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনারত অবস্থায় নিশ্চল প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে তার মনিবের। লিভিংস্টোন ৬০ বছর বয়সে বর্তমান জাম্বিয়ার লেক ব্যাংয়েউলু দক্ষিণ-পূর্বে ইলালায় চিফ চিতাম্বোর গ্রামে ম্যালেরিয়া এবং অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণজনিত কারণে পেটের রোগের কারণে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সেই সাইটটি এখন লিভিংস্টোন মেমোরিয়াল হিসাবে পরিচিত, বিশ্বাসী চুমা ও সুসি অন্যদের সাহায্যে অসাধারণ কষ্ট স্বীকার করে পাহাড় জঙ্গল পার হয়ে, সমুদ্রের কূল পর্যন্ত তার মৃতদেহ বয়ে এনে জাহাজে তুলে দিয়েছিল। লিভিংস্টোনের বীরত্বে, গৌরবে গৌরবান্বিত দেশ তার পার্থিব দেহ সমাহিত করল 'ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে’।

লিভিংস্টোন এবং দাসত্ব

আরব দাস ব্যবসায়ী এবং তাদের বন্দীদের

  :

আফ্রিকা অভিযানে তার সঙ্গে  সে-দেশীয় দু-চারজন লোক ছাড়া আর কেউ ছিল না। কিন্তু তারা তাঁকে এত ভালবাসত যে, ঘোর বিপদের মধ্যেও তাঁকে ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি।

লিভিংস্টোনও তাদের ভালবেসেছিলেন। সেই আধাঁর দেশের লোকের দুঃখে তার যে কি দুঃখ ও বেদনা ছিল — তার লেখায় পাওয়া যায়। পর্তুগীজদের অত্যাচারের বর্ণনা করতে গিয়ে তার কথাগুলো যেন আগুন জ্বলে  হয়ে উঠত। মৃত্যুর পূর্বে তার শেষ লেখা —

"এই নির্জন দেশে বসে আমি এই মাত্র বলতে পারি, পৃথিবীর এই কলঙ্ক (দাস ব্যবসায়) যে মুছে দিতে পারবে—ভগবানের অজস্র আশীর্বাদে সে ধন্য হয়ে যাবে।"


Новое сообщение