Продолжая использовать сайт, вы даете свое согласие на работу с этими файлами.
পরমহংস যোগানন্দ
পরমহংস যোগানন্দ | |
---|---|
জন্ম | ৫ জানুয়ারি, ১৮৯৩ |
মৃত্যু | ৭ মার্চ, ১৯৫২ লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
|
পরমহংস যোগানন্দ (সংস্কৃত: परमहंस योगानंद; আবির্ভাব- জানুয়ারি ৫, ১৮৯৩ এবং তিরোভাব: মার্চ ৭, ১৯৫২) একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, যোগী এবং গুরু।
ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন অধ্যাত্মবিজ্ঞান ক্রিয়াযোগ সাধনার ধারাকে বিশ্বের আপামর জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিধিনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করার জন্যই তিনি এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি একজন জগদগুরু। মায়াপ্রপঞ্চময় এই জগতের লক্ষ লক্ষ দিশাহীন লোকের জীবনে তিনি আশার ধ্রুবতারা হয়ে দেখা দিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠিত আধ্যাত্মিক সংস্থা যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া। ও ‘সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপ'-এর মাধ্যমে অগণিত মানুষ ক্রিয়াযোগ সাধনায় অভিষিক্ত হয়ে জীবনে নতুন চলার পথ খুঁজে পেয়েছে। তার আত্মজীবনী 'যোগী-কথামৃত' বা 'Autobiography of a Yogi' গ্রন্থটি আজ একটি অত্যুৎকৃষ্ট আধ্যাত্মিক রচনা হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র স্বীকৃতিলাভ করেছে এবং বিশ্বের ৫২ টি ভাষায় অনূদিত হয়ে অসংখ্য মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের মানোন্নয়নের জন্য এক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে চলেছে। ভারতের গোরখপুর শহরে জন্মগ্রহণ করলেও তার জীবনের শেষের তিনটি দশক কেটেছে আমেরিকা ও ইউরোপে ভারতের সনাতন যোগ ও ধ্যানপদ্ধতির প্রচার ও প্রসারে। আজ সারা বিশ্বে যোগ ও ধ্যানের প্রতি যে অভূতপূর্ব আকর্ষণ দেখতে পাওয়া যায়, তার মূলে রয়েছে পরমহংস যোগানন্দের তিন দশকব্যাপী অক্লান্ত প্রচেষ্টা। তাই তাঁকে 'পশ্চিম বিশ্বে যোগের জনক' (Father of Yoga in the West) নামে অভিহিত করা হয়।
প্রাথমিক জীবন
শৈশবে তার নাম রাখা হয়েছিল মুকুন্দলাল ঘোষ। পিতা শ্রী ভগবতী চরণ ঘোষ ও মাতা শ্রীমতী জ্ঞানপ্রভা দেবীর আট পুত্রকন্যার মধ্যে মুকুন্দলাল ছিলেন দ্বিতীয় পুত্র ও চতুর্থ সন্তান।
পরমহংস যোগানন্দের জন্মগ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি ঘটনা সম্বন্ধে অবহিত না থাকলে তার পৃথিবীতে আগমনের তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে না। প্রথমটি ঘটেছিল ১৮৬১ সালে, যখন রাণীক্ষেতে অফিসের কাজে বদলি হয়ে আসা তেত্রিশ বছরের যুবক শ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী দ্রোণগিরি পাহাড়ে মৃত্যুঞ্জয়ী মহাগুরু মহাবতার বাবাজি মহারাজের কাছে ক্রিয়াযোগে দীক্ষাপ্রাপ্ত হন। শ্যামাচরণ লাহিড়ীকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত করে বাবাজি মহারাজ জানালেন, শ্রীমদভাগবতগীতায় যে প্রাণায়ামের উল্লেখ আছে, সেই ক্রিয়াযোগবিজ্ঞান কালের প্রভাবে এতদিন হিমালয়ের গিরিগুহায় গুপ্তভাবে সংরক্ষিত ছিল; এখন সময় হয়েছে তাকে অর্গলমুক্ত করে আপামর জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার। দীক্ষান্তে লাহিড়ী মহাশয় নেমে এলেন সমতলে এবং হাজার হাজার ভক্ত নরনারীকে ক্রিয়াযোগ সাধনায় অভিষিক্ত করতে থাকলেন।
দ্বিতীয় ঘটনার সূত্রপাত ১৮৯৪ সালে কুম্ভমেলায় যখন শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি বাবাজি মহারাজের সাক্ষাৎলাভ করেন। শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি ছিলেন পূর্বোক্ত লাহিড়ী মহাশয়েরই এক অগ্রগণ্য শিষ্য। বাবাজি মহারাজ তাঁকে জানালেন, ক্রিয়াযোগ বিজ্ঞানের আশীর্বাদ শুধু ভারতবর্ষের গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক, এটা ঈশ্বরের অভিপ্রায় নয়। তিনি এও জানালেন যে ভারতবর্ষের এই অনন্য আধ্যাত্মিক সম্পদটিকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত করার জন্য তিনি একজনকে নির্বাচিত করেছেন যাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করে বিদেশে পাঠানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে প্রস্তুত করার দায়িত্ব তিনি শ্রীযুক্তেশ্বরকেই দিতে চান। ১৮৯৩ সালে জন্মগ্রহণ করা মুকুন্দলাল ঘোষই ছিলেন সেই নির্বাচিত ব্যক্তি (পরবর্তীকালে সন্ন্যাসগ্রহণের পর তিনিই পরিচিত হন পরমহংস যোগানন্দ নামে)।
মুকুন্দলালের পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন লাহিড়ী মহাশয়ের শিষ্য। তার জন্মের অব্যবহিত পরেই একবার তারা শিশু মুকুন্দকে লাহিড়ী মহাশয়ের কাছে নিয়ে যান। লাহিড়ী মহাশয় তাঁকে কোলে বসিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন - 'এই ছেলে একদিন মহাযোগী হবে এবং আধ্যাত্মিক ইঞ্জিনের মতো বহুলোককে ভগবানের রাজ্যে টেনে নিয়ে যাবে।'
জীবনী
শৈশব ও কৈশোর
একটু বড় হলে মুকুন্দ ভর্তি হলেন গোরখপুরের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ স্কুলে। মুকুন্দ যে সবার থেকেই স্বতন্ত্র, সেটা অনেকেই এই সময় থেকে বুঝতে শুরু করলেন। অন্যান্য ছেলেরা যখন সময় পেলেই খেলাধুলায় মত্ত হয়ে থাকত, মুকুন্দ কিন্তু তা করত না। নির্জন নিরিবিলি জায়গা পেলেই নিমীলিত চোখে সে ধ্যানস্থ হয়ে থাকত। ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে যেত, ছোট্ট মুকুন্দ ওঠবার নামটি করত না। জ্ঞানপ্রভাদেবী যখন লাহিড়ী মহাশয়ের প্রতিকৃতির সামনে পুজোয় বসতেন, মুকুন্দও গুটি গুটি পায়ে পৌঁছে যেত পুজোর ঘরে। মা আর ছেলের সম্মিলিত আত্মনিবেদনে লাহিড়ী মহাশয়ের প্রতিকৃতি যেন জীবন্তরূপ ধারণ করে উঠত।
মুকুন্দর যখন এগারো বছর বয়স, তার মা জ্ঞানপ্রভাদেবীর মৃত্যু হয়। বড়ছেলে অনন্তের বিয়ে উপলক্ষ্যে তিনি তখন কলকাতায়। মাতার আকস্মিক মৃত্যু মুকুন্দর অন্তর্জগৎকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল। জ্ঞানপ্রভাদেবী ছিলেন তার অন্তর্লোকের দেবী, তার সমস্ত সুখদুঃখ, আনন্দবেদনার শেষ আশ্রয়স্থল। যন্ত্রনাদগ্ধ হৃদয়ের অসীম হাহাকারের মাঝেই একদিন মুকুন্দ শুনতে পেল জগজ্জননীর অভয়বাণী—“জন্মে জন্মে তোমার মায়েদের কাছ থেকে যে স্নেহ ভালোবাসা তুমি পেয়েছ, তা তো আমারই দেওয়া। এ জন্মে যে মাকে হারিয়ে তুমি দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছ, আমার মধ্যেই আবার তা খুঁজে পাবে।”
সদ্গুরুর কাছে দীক্ষালাভ
ক্রমশ ঈশ্বরপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা মুকুন্দের হৃদয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। হিমালয়ের তুষারধবল গিরিশ্রেণী এবং তার নির্জন গুহায় সাধনার অতৃপ্ত বাসনা মুকুন্দকে আর স্থির থাকতে দিল না। মুকুন্দর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠল যে গুরুর আশীর্বাদ ছাড়া ঈশ্বরপ্রাপ্তি অসম্ভব এবং সেই গুরুকে খুঁজে পাওয়া যাবে হিমালয়ের চিরতুষারাবৃত অঞ্চলে। এই বিবেচনায় মুকুন্দ আরও দুই বন্ধুর সাথে হিমালয়ের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চেপে বসল। দাদা অনন্তের আপ্রাণ চেষ্টায় এই যাত্রা নিষ্ফল হলেও পরিণামে পাওয়া গেল সর্বশাস্ত্রে পারঙ্গম ঋষিসুলভ চরিত্রের অধিকারী স্বামী কেবলানন্দজি মহারাজের পবিত্র সান্নিধ্য। লাহিড়ী মহাশয়ের এক অতি উন্নত শিষ্য কেবলানন্দজি নিযুক্ত হলেন মুকুন্দর গৃহশিক্ষক হিসেবে। এইরকম সময়ে তিনি একে একে দর্শন করলেন লাহিড়ী মহাশয়ের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম স্বামী প্রণবানন্দ গিরি, বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেব, সোহহং স্বামী (শ্রী শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়), লঘিমাসিদ্ধ সাধু নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী এবং রামকৃষ্ণ কথামৃত রচনাকার শ্ৰীম অর্থাৎ শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে।
১৯০৯ সাল। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মুকুন্দ স্থির করলেন, এবার ঈশ্বর সন্ধানে গৃহত্যাগ করা প্রয়োজন। বন্ধু জিতেন্দ্রনাথ মজুমদার তখন কাশিতে শ্রীভারত ধর্মমহামণ্ডল আশ্রমে বসবাস করতেন। মুকুন্দ সেখানেই যাওয়া স্থির করলেন। প্রথমে সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে মুকুন্দকে গ্রহণ করলেও ক্রমে আশ্রমিকদের মধ্যে একটা বিরুদ্ধভাব জন্মাতে শুরু করল। ভগবানকে পাওয়ার জন্য মুকুন্দর অতিরিক্ত আবেগ, আশ্রমের চিলেকোঠার ঘরে তার ঘন্টার পর ঘন্টা ধ্যানে কাটিয়ে দেওয়া - অনভ্যস্ত আবাসিকবৃন্দের কাছে এসবই কাজ ফাঁকি দেওয়ার কৌশল বলে বোধ হল। এমনই একটা দিনে সমালোচনার বহর মাত্রাছাড়া হওয়াতে মুকুন্দ ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে মাতা ভগবতীর কাছে সদ্গুরু লাভের জন্য আকুল প্রার্থনায় ভেঙে পড়লেন। ঘন্টা দুয়েক অস্থিরতার পর অন্তরে তার বাণী প্রকাশিত হল – “তোমার গুরু আজই আসছেন”।
কিছুক্ষণ বাদেই মুকুন্দকে বাজারে যেতে বলা হল। সেখানে বাঙালি টোলার কাছে এক গলিতে আচম্বিতে মুকুন্দর নজরে এল, গলির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এক সৌম্যদর্শন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী। তার দীর্ঘ বাবরি চুল, ঋজু শরীর, তেজোময় আননে প্রশান্ত দৃষ্টি - মুকুন্দ নিঃসংশয়ে বুঝলেন, ইনিই তার গুরুদেব। মুকুন্দ প্রনত হলেন শ্রীগুরুদেবের চরণতলে। আজ থেকে শুরু হল তার নতুন জীবন। সেটা ১৯১০ সাল। মুকুন্দর বয়স তখন সতেরো।
মুকুন্দর গুরুদেব শ্রীযুক্তেশ্বর গিরির নিবাস শ্রীরামপুরে, রাইঘাট লেনে। প্রথম যেদিন মুকুন্দ শ্রীরামপুর আশ্রমে পদার্পণ করলেন, শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি বিধান দিলেন, “যাও, গিয়ে কলেজে ভর্তি হও। গীতোক্ত ক্রিয়াযোগবিজ্ঞান যা সহস্রাব্দকাল ধরে লুপ্ত হয়ে থাকার পর বাবাজি এবং লাহিড়ী মহাশয়ের হাত ধরে পুনরাবিষ্কৃত হয়েছে, পশ্চিমে তার প্রচার করার জন্যই তোমার আসা। এই কাজে কলেজের ডিগ্রি তোমার সহায় হবে।” গুরু আজ্ঞা শিরোধার্য করে মুকুন্দ ভর্তি হলেন কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজে।
সমাধির অভিজ্ঞতা
পরবর্তী একটি দশকের বেশির ভাগ সময়েই মুকুন্দ তার গুরু শ্রীযুক্তেশ্বর গিরির তত্ত্বাবধানে বিধিনির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের জন্য তৈরি হতে লাগলেন। শ্রীরামপুর আশ্রমে থাকাকালীনই মুকুন্দর সমাধির অনুভূতি হয়। সমাধির অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য মুকুন্দ বিশেষভাবে লালায়িত ছিলেন। একদিন এল সেই বাঞ্ছিত মুহূর্ত। ধ্যানরত মুকুন্দকে ডেকে পাঠিয়ে শ্রীযুক্তেশ্বরজি তার বুকে মৃদু করাঘাত করলেন। আর মুকুন্দর চোখের সামনে যেন এক অজানা জগতের সীমাহীন রহস্য একের পর এক নীরবে উন্মোচিত হতে থাকল। আত্মচেতনা ক্ৰমপ্রসারিত হয়ে যেন সৃষ্টির শেষ প্রান্ত অবধি বিস্তৃত হল, আর সেই সর্বব্যাপী চৈতন্যের প্রেক্ষাপটে সমগ্র মহাবিশ্বকে মনে হল অনন্ত জ্যোতিসমুদ্রে ভাসমান এক ক্ষণস্থায়ী বুদ্বুদ মাত্র।
সন্ন্যাসগ্রহণ ও আমেরিকা যাত্রা
১৯১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর মুকুন্দর জীবনে ঘটল এক পরম আকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ওই বছরের জুলাই মাসের এক বৃহস্পতিবার শ্রীযুক্তেশ্বরজি তাঁকে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত করলেন, নাম রাখলেন স্বামী যোগানন্দ গিরি। মুকুন্দর আবাল্যের স্বপ্ন অবশেষে বাস্তবায়িত হল। সন্ন্যাস গ্রহণের অব্যবহিত পরেই শ্রীযুক্তেশ্বরজি একদিন ডেকে বললেন, “ব্রহ্মানন্দের যে মাধূর্য তুমি আস্বাদন করেছ, আরও দশ জনের সঙ্গে কেন তা ভাগ করে নিচ্ছ না?” শ্রীগুরুর নির্দেশ পেয়ে যোগানন্দজি তখনই কাজে লেগে পড়লেন। কাশিমবাজারের মহারাজা শ্রী মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী মহাশয়ের আর্থিক সহায়তায় বর্ধমান জেলার দামোদর স্টেশনের কাছে ডিহিকা গ্রামে অবশেষে একটি স্কুল খোলা হল। মাত্র সাতটি ছাত্র এবং কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে ১৯১৭ সালের ২২শে মার্চ মহাবিষুব সংক্রান্তিতে স্কুলের প্রতিষ্ঠা হল। নাম রাখা হল ‘যোগদা সৎসঙ্গ ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়।’ এই দিনটিকেই স্বামী যোগানন্দজির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সংস্থা 'যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া'-র প্রতিষ্ঠাদিবস হিসেবে গণ্য করা হয়।
ছাত্রসংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বছর খানেকের মধ্যেই স্কুলটি রাঁচিতে মহারাজের গ্রীষ্মকালীন রাজপ্রাসাদে স্থানান্তরিত হল। সাধারণ শিক্ষাদীক্ষার বাইরেও সেখানে ছাত্রদের যোগ ও ধ্যানের পদ্ধতি এবং প্রাণশক্তির সাহায্যে সম্পূর্ণ দেহকে উজ্জীবিত করার জন্য যোগানন্দজি কর্তৃক উদ্ভাবিত শক্তিসঞ্চার ব্যায়ামও শেখানো হত। ১৯২০ সালে সেখানেই একদিন ধ্যানরত অবস্থায় যোগানন্দজির মানসপটে কয়েকটি অপরিচিত বিদেশি মুখের অবয়ব ভেসে উঠল। ধ্যাননেত্রে তিনি দেখলেন, মুখগুলি আমেরিকানদের এবং সুস্পষ্টভাবেই অনুভব করলেন, পশ্চিমে যাওয়ার যে রহস্যময় ইঙ্গিত তিনি নানাজনের কাছে বারবার পেয়েছেন, তার মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়েছে। কালবিলম্ব না করে তিনি কলকাতায় চলে এলেন। পরের দিনই তার কাছে একটি আমন্ত্রণপত্র এসে পৌঁছোল। আমেরিকান ইউটেরিয়ান এসোসিয়েশন সে বছরের অক্টোবর মাসে বোস্টন শহরে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ রিলিজিয়াস লিবারেলস-এর মহা সম্মেলন আয়োজন করতে চলেছে। সেখানেই ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তিনি মনোনীত হলেন। শ্রীযুক্তেশ্বরজি আশীর্বাদ দিয়ে বললেন, “সকল দুয়ারই তো তোমার জন্য খোলা জানবে, এখন না হলে আর কখনও তোমার যাওয়া হবে না।” যোগানন্দজি তবু সংশয়াকুল, একে তো দূরদেশ, তায় আমেরিকার ঘোর জড়বাদী সভ্যতা! ভারতের আধ্যাত্মিক চেতনায় পুষ্ট তার মনন কীভাবে সেখানকার জীবনধারায় নিজের ঠাঁই করে নেবে, সে কথা ভেবে তিনি যারপরনাই শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। অতঃপর শুরু হল তার প্রার্থনা, অবিরাম, ছেদহীন, নিরন্তর। ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ আশ্বাসবাণী না শোনা পর্যন্ত প্রার্থনা চলতেই থাকল। সকাল গড়িয়ে দুপুর এল, তবু প্রার্থনার বিরাম নেই। এমন সময়ে যোগানন্দের ঘরে আবির্ভূত হলেন এক মহিমময় মহাপুরুষ, মহাবতার বাবাজি মহারাজ স্বয়ং। আশীর্বাণী উচ্চারণ করে তিনি বললেন, “ঈশ্বর তোমার প্রার্থনা শুনে আমাকে পাঠিয়েছেন এ কথা বলতে যে গুরুআজ্ঞা মান্য করে তুমি আমেরিকা যাও। ঈশ্বর সর্বদাই সেখানে তোমাকে রক্ষা করবেন। আর এ কথা মনে রেখো যে আমিই তোমাকে পাশ্চাত্যে ক্রিয়াযোগ প্রচার ও প্রসারের জন্য নির্বাচিত করেছি।” মৃত্যুঞ্জয়ী মহাগুরুর দর্শন ও পুণ্যস্পর্শে যোগানন্দ নিঃসংশয় হলেন, আমেরিকা যাওয়াই তার বিধিলিপি।
১৯২০ সালের আগস্ট মাসে ‘দি সিটি অফ স্পার্টা’ নামক জাহাজে যোগানন্দজি আমেরিকায় পাড়ি দিলেন। সে বছরেরই ৬ই অক্টোবর তারিখে বোস্টন শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রথম ভাষণ দিলেন যোগানন্দজি। বিষয় ছিল ‘The Science of Religion’ বা ধর্মবিজ্ঞান। যোগানন্দজি বললেন, ধর্ম কোনো মতবাদের বিষয় নয়, ধ্যানের বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দৈবীচেতনার সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযোগস্থাপনের নামই ধর্ম। ভারতের এই নবীন সন্ন্যাসীর নাম মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল বিদগ্ধমহলে। নানা সংস্থার কাছ থেকে তার কাছে বক্তৃতাদানের জন্য অনুরোধ আসতে লাগল। শরীর, মন ও আত্মার সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নতিবিধানের মাধ্যমে ভগবৎলাভ ও সেই কাজে ভারতের ঋষিদের উদ্ভাবিত সুপ্রাচীন ক্রিয়াযোগ বিজ্ঞানের অবদান — যোগানন্দজির এই জ্ঞানগর্ভ ভাষণ শুনতে সারা শহর যেন ভেঙে পড়ত। কয়েক হাজার আসন সমন্বিত প্রেক্ষাগৃহের প্রতিটি আসন পূর্ণ হওয়ার পরেও বিফলমনোরথ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন আরও হাজার হাজার মানুষ। ১৯২০ সালেই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন Self-Realization Fellowship।
আমেরিকায় যোগানন্দজির প্রথম ক্রিয়াবান শিষ্য ছিলেন এম. ডব্লিউ. লুইস। ১৯২০ সালেরই ২৪শে ডিসেম্বর তারিখে তিনি যোগানন্দজিকে নিজের গুরুরূপে স্বীকার করে নিলেন। পরবর্তী তিনটি বছর বোস্টন শহরকে কেন্দ্র করে প্রধানত আমেরিকার পূর্ব উপকূলেরই বিভিন্ন শহরে তিনি বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালেন। ১৯২৪ সালে দু-তিনজন সঙ্গী সহ তিনি একটি আন্তর্মহাদেশীয় মোটরযাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন। বিভিন্ন শহরে বক্তৃতা দিতে দিতে ১৯২৫ সালে পৌঁছোলেন ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের লস্ অ্যাঞ্জেলেস শহরে। ১৯২৫ সালে সেখানকার মাউন্ট ওয়াশিংটনে স্থাপন করলেন প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর।
১৯২৫ সালের জুলাই মাসে সিয়েটল শহরে য়োগানন্দজির সঙ্গে পরিচিত হন এডিথ বিসেট নাম্নী এক মহিলা। পরিচয়ের প্রথমক্ষণেই যোগানন্দজি তাকে পূর্বজন্মের এক শিষ্যরূপে চিনতে পারেন। পরবর্তীকালে সন্ন্যাস গ্রহণ করে এডিথ শ্রীজ্ঞানমাতা নামে পরিচিত হন এবং মাউন্ট ওয়াশিংটন আশ্রমে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৩১ সালে মাউন্ট ওয়াশিংটন আশ্রমে বসবাসের জন্য এলেন ফে রাইট নামের সতেরো বছর বয়সের এক কিশোরী। সন্ন্যাস গ্রহণকালে তার নাম রাখা হয় শ্রীদয়ামাতা যিনি পরবর্তীকালে যোগানন্দজির বিশ্বব্যাপী আধ্যাত্মিক সংস্থার দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন বলে বিধিনির্দিষ্ট হয়ে আছেন। যোগানন্দজির চুম্বকীয় আকর্ষণে এবং তার দিব্য প্রেমের বাঁধনে একে একে ধরা দিলেন আমেরিকার বহু নরনারী। তবে যোগানন্দজি সবচেয়ে বেশি তৃপ্ত হয়েছিলেন জেমস জে. লীন নামক এক শিষ্যকে কাছে পেয়ে। সন্ন্যাস দীক্ষাদানের শেষে তার নাম রেখেছিলেন রাজর্ষি জনকানন্দ।
এভাবে কেটে গেল দীর্ঘ ১৫টা বছর। এল ১৯৩৫ সাল। একদিন ধ্যানমগ্ন যোগানন্দজির অন্তরে ভেসে এল তার গুরুদেবের আকুল আহবান – “যোগানন্দ, শীঘ্রই আমি দেহত্যাগ করে অসীমের পানে পাড়ি দেব। একবার ভারতে এস।”
ভারতে প্রত্যাবর্তন (১৯৩৫-১৯৩৬)
দুটি শিষ্য-শিষ্যা নিয়ে ১৯৩৫ সালের জুন মাসে যোগানন্দজি ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। শ্রীরামপুর আশ্রমে গুরু-শিষ্যের মিলন হল। কয়েকদিন বাদে শ্রীযুক্তেশ্বরজি তার শিষ্যকে ডেকে পরমহংস উপাধি প্রদান করলেন। স্বামী যোগানন্দের পরিবর্তে এবার থেকে তিনি পরিচিত হলেন পরমহংস যোগানন্দরূপে। পরমহংস উপাধি অধ্যাত্মজগতে সর্বোৎকৃষ্টতার দ্যোতক।
সেক্রেটারি রিচার্ড রাইটকে নিয়ে যোগানন্দজি এবার ভারত পরিভ্রমণে বেরোলেন। প্রথমেই গেলেন রাঁচি; তার প্রতিষ্ঠিত যোগদা সৎসঙ্গ ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়টিকে সুদৃঢ় আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে এরপর গেলেন ডিহিকা – তার প্রথম আশ্রম স্কুল। এরপর দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ, সেখানে দেখা করলেন মহর্ষি রমণের সঙ্গে। ১৯৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ণকুম্ভে যোগদানের উদ্দেশ্যে গেলেন এলাহাবাদ, সেখান থেকে বৃন্দাবনে লাহিড়ী মহাশয়ের আর এক বিখ্যাত শিষ্য স্বামী কেশবানন্দজির সঙ্গে সাক্ষাৎকার সেরে কলকাতায় ফিরেই খবর পেলেন শ্রীযুক্তেশ্বরজি পুরীতে গুরুতর অসুস্থ। গুরুদেবের প্রাণরক্ষার্থে ভগবানের কাছে আকুল প্রার্থনা জানিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। ১৯৩৬ সালের ৯ই মার্চ, পুরীর কড়ার আশ্রমে শ্রীযুক্তেশ্বরজি মহাসমাধিতে লীন হয়ে গেলেন।
পার্থিব দেহধারণ করে শ্রীযুক্তেশ্বরজির আবির্ভাব
ভগ্নমনোরথ যোগানন্দজি আমেরিকা ফিরে যাবার জন্য জুন মাসে মুম্বাই এসে পৌঁছোলেন। গুরুর বিচ্ছেদ বেদনায় মন তখনও অস্থির, চিত্ত শোকাকুল, হৃদয়ে চূড়ান্ত হাহাকার। এমনই এক দিনে সেখানকার রিজেন্ট হোটেলে বিকেল বেলায় যোগানন্দজির ঘরে অত্যুজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণের মাঝে শ্রীযুক্তেশ্বরজি পার্থিব শরীর ধারণ করে পুনরায় আবির্ভুত হলেন নিজের প্রিয়তম শিষ্যের সামনে। কালান্তক মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ যে দেহকে চিরকালের মতো ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে পুরীর বালুকাবেলায়, অবিকল সেরকমই একটি দেহ তিনি নিজের ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে তৈরি করেছেন, কিন্তু এ দেহ যেন আরও উজ্জ্বল, আরও জ্যোতির্ময়। বিস্ময়বিমূঢ় শিষ্যের সামনে এবার তিনি প্রকাশ করতে লাগলেন সূক্ষ্মজগতের যাবতীয় রহস্য, যেখানকার তিনি এখন চিরস্থায়ী বাসিন্দা। এর সম্পূর্ণ বিবরণটাই আমরা পাই যোগানন্দজির আত্মচরিত 'যোগী-কথামৃত' গ্রন্থে।
আমেরিকা ফিরে যাওয়ার আগে আরও দুই মহান ব্যক্তিত্বের সাথে যোগানন্দজির পরিচয় ঘটে। তাদের মধ্যে একজন হলেন মহাত্মা গান্ধী, যিনি ওয়ার্ধায় যোগানন্দজির কাছে ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত হয়েছিলেন। দ্বিতীয়জন হলেন শ্রীশ্রী আনন্দময়ী মা।
'যোগী-কথামৃত' ও অন্যান্য গ্রন্থ রচনা
আমেরিকাবাসের দ্বিতীয় পর্যায়ে যোগানন্দজি নিজেকে নিয়োজিত করলেন কয়েকটি মহাগ্রন্থ রচনার কাজে। তাদের মধ্যে একটি হল নিজের আত্মজীবনী, 'Autobiography of a Yogi' বা 'যোগী-কথামৃত'। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এটি এক কালজয়ী মহাগ্রন্থের শিরোপা অর্জন করে। এই গ্রন্থটির মাধ্যমে জনসমক্ষে সর্বপ্রথম যোগিরাজ লাহিড়ী মহাশয়ের জীবনী প্রকাশিত হল। যোগিরাজের জীবৎকালে যখনই শিষ্যরা তার জীবনী প্রকাশে উদ্যোগী হতেন, তিনি তাদের নিরস্ত করতেন এই বলে যে তার দেহাবসানের পঞ্চাশ বছর পরে তার জীবনী প্রকাশিত হবে। যোগিরাজ দেহত্যাগ করেন ১৮৯৫ সালে, আর অটোবায়োগ্রাফি প্রকাশিত হয় ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে। এছাড়াও এই বইটির মাধ্যমেই মহাবতার বাবাজির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় তাবৎ বিশ্ববাসীর কাছে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। যোগানন্দজি বাবাজির একটি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে গ্রন্থটিতে সন্নিবিষ্ট করেছেন। বাস্তবে এটাই বাবাজির দৈহিক অবয়বের একমাত্র প্রামানিক প্রতিলিপি। এছাড়াও, তিনি রচনা করলেন শ্রীমদভাগবতগীতার যৌগিক ভাষ্য ‘God Talks With Arjuna'। ভারতের সনাতন যোগধর্মের আলোয় লিখলেন বাইবেলের ব্যাখ্যা ‘The Second Coming of Christ’। এছাড়াও লিখলেন পারস্যের মরমিয়া কবি ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎগুলির আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা।
নির্বিকল্প সমাধি
১৯৪৮ সালের জুন মাসের এক সন্ধ্যাকাল। যোগানন্দজি সেদিন যোগসাধনার সর্বোত্তম স্তর অর্থাৎ নির্বিকল্প সমাধিতে প্রবেশ করলেন। মাউন্ট ওয়াশিংটনের প্রায়ান্ধকার ঘরে কয়েকজন শিষ্য-শিষ্যার উপস্থিতিতে একটি অতীব রোমাঞ্চকারী ঘটনা ঘটেছিল, সাধনজগতের ইতিহাসে যার তুলনা মেলা ভার। নির্বিকল্প সমাধিচেতনায় অধিষ্ঠিত যোগানন্দজি মা ভগবতীকে সামনে পেয়ে বালকসুলভ সারল্যে হৃদয়ে জমানো অনেক না-বলা কথা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বলে চললেন। দু-নয়নে বয়ে চলেছে অবিরাম অশ্রুধারা, কন্ঠে সুগভীর আর্তি। উপস্থিত শিষ্য-শিষ্যারা স্তম্ভিত ও বিস্ময়বিহ্বল হয়ে পড়লেন যখন দেখলেন মা ভগবতী স্বয়ং যোগানন্দজির গলায় একে একে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিলেন। সারারাত এভাবে কেটে গেল মা আর ছেলের মধুর আলাপচারিতায়।
মহাসমাধি
যোগানন্দজি ক্রমশ উপলব্ধি করছিলেন, পৃথিবীতে তার বসবাসের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। অনেক আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করা বাকি, কিন্তু মহামায়া আর তাঁকে পার্থিব দেহের নিগড়ে আবদ্ধ রাখতে চান না। অবশেষে বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে এল। ১৯৫২ সালের ৭ই মার্চ। আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রী বিনয়রঞ্জন সেনের আতিথ্য উপলক্ষ্যে লস্ অ্যাঞ্জেলেস শহরের বিল্টমোর হোটেলে এক সান্ধ্যকালীন ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে। তার কয়েকদিন আগে থেকেই তিনি নানাভাবে শিষ্য-শিষ্যাদের আসন্ন মহাপ্রয়াণের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। তার তিরোধানের পর তার সাধের প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে, এই প্রশ্নের উত্তরে দ্বিধাহীন চিত্তে জানিয়েছেন, একমাত্র ভালোবাসাই তার স্থান পূর্ণ করতে পারবে। প্রয়োজন শুধু ঈশ্বরের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা, কুণ্ঠাহীন আনুগত্য ও একান্ত আত্মসমর্পন। তাহলেই তার প্রতিষ্ঠান চিরস্থায়ী হবে।
লস্ অ্যাঞ্জেলেসের বিল্টমোর হোটেল। আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে যোগানন্দজি জীবনের শেষ বক্তৃতা দিতে উঠলেন। স্বরচিত কবিতা ‘My India’ থেকে পাঠ করতে থাকলেন –
Where Ganges, woods, Himalayan caves, and men dream God—
I am hallowed; my body touched that sod.
[যেথা গঙ্গা, বনানী, হিমালয় কন্দর ও মানুষ করে ঈশ্বর-স্মরণ
আমি পবিত্র, কারণ এ দেহ আমার পেয়েছে তারই পুণ্য-পরশন]
কবিতার শেষ চরণটি উচ্চারণ করা মাত্র তিনি কূটস্থে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মহাসমাধিতে লীন হয়ে গেলেন। অধ্যাত্মজগতের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কদের মধ্যে অন্যতম, প্রাচ্যভূমির বাইরে জড়বাদী চেতনার ঊষরভূমিতে ক্রিয়াযোগের মঙ্গলবারি সিঞ্চনে ভাগীরথী পুরুষ পরমহংস যোগানন্দ তার নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করে অমরলোকে যাত্রা করলেন।
বিবিধ কারণে তার দেহ সমাধিস্থ করতে বিলম্ব হতে লাগল। একে একে কুড়িটি দিন কেটে গেল, কিন্তু সবিস্ময়ে সবাই লক্ষ্য করলেন, তার পবিত্র দেহ কুড়িদিন বাদেও একইরকম অবিকৃত রয়ে গেছে। পচনের কোনো চিহ্ন বা দুর্গন্ধের কোনো আভাষ – কিছুই তাতে নেই। বাহ্যিক কোনো উপাদান ব্যতিরেকেই যোগানন্দজির পূত শরীর মহাপ্রয়াণের কুড়িদিন পরেও একইরকম সতেজ, ত্বক একইরকম উজ্জ্বল! ফরেস্ট লন মেমোরিয়ালের ডিরেক্টর – যেখানে যোগানন্দজিকে অবশেষে সমাধিস্থ করা হয় – বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ঘোষণা করলেন, “যোগানন্দজির দেহত্যাগ আমাদের অভিজ্ঞতায় একেবারে অভূতপূর্ব ঘটনা। কারণ তার শ্রীঅঙ্গ তিরোভাব পরবর্তী দেহবিকৃতির যাবতীয় ভৌতিক নিয়মকে পরাভূত করে স্বমহিমায় বিরাজমান থেকেছে।”
লেসন্স
সাধনজগতে আগ্রহী ভক্তকুলের জন্য যোগানন্দজির এক অমূল্য উপহার তার লেসন্স বা ধারাবাহিক শিক্ষাবলি যা বাড়িতে বসে পড়ার জন্য প্রতিটি শিষ্য-শিষ্যার কাছে নিয়মিতভাবে পাঠানো হয়। ধর্ম-মহাসম্মেলন শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে যোগানন্দজির ভাষণের অব্যবহিত পরেই অনেকেই এসে তার কাছে সাধনা শুরু করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। প্রথমদিকে তিনি যোগ ও ধ্যানের মূল প্রক্রিয়াগুলি ক্লাসের মাধ্যমেই তার ছাত্রদের জানিয়ে দিতেন। কিন্তু ১৯২৫ সালের পর তার ক্ৰমবৰ্ধমান ছাত্রসংখ্যার জন্য তিনি একটি ধারাবাহিক নির্দেশাবলির কথা ভাবতে শুরু করেন যার উদ্দেশ্য ছিল ছাত্ররা যেন নিজেদের বাড়িতে বসেই তার প্রক্রিয়াসমূহের অভ্যাস চালিয়ে যেতে পারে এবং তার নির্দেশিত জীবনযাপনের পদ্ধতি সম্বন্ধে অবহিত থাকতে পারে। ক্রমশই তিনি নূতন নূতন বিষয় ও তথ্য তাতে সংযোজিত করতে শুরু করলেন যাতে ঈশ্বর, তার সৃষ্ট এই জগৎ এবং এই প্রেক্ষাপটে মানুষের ভূমিকা সম্বন্ধে একটি সামগ্রিক রূপরেখা ছাত্রদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। বেশ কয়েকবার পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়ে ১৯৩৪ সালে প্রায় ২০০ টি আলাদা আলাদা লেসন্স (তখন তার নাম ছিল Praeceptum) তৈরি হয়। পরবর্তী ১৮ বছরে যোগানন্দজি তার মহাসমাধির সময় পর্যন্ত (১৯৩৪-১৯৫২) নিজের বিভিন্ন ভাষণ, লিখিত রচনা এবং অসংখ্য ব্যক্তিগত সৎসঙ্গ থেকে তথ্য ও বিষয়াদি নিয়ে একটি বিপুল ও পূর্ণাঙ্গ লেসন্স বা পাঠমালা প্রস্তুত করার দায়িত্ব শ্রী মৃণালিনী মাতাকে অর্পণ করে যান। ১৯৫২ সালে তার মহাসমাধির আগে তিনি মৃণালিনী মাতাকে বলে যান, "নতূন এই লেসন্স তৈরি করা হবে তোমার সারাজীবনের কাজ।" পরবর্তী ছয়টি দশক মৃণালিনী মাতা এই সংকলনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন, যার ফলশ্রুতি হিসেবে ২০১৭ সালে YSS/SRF-এর বর্তমান অধ্যক্ষ স্বামী চিদানন্দজি এই লেসন্সটি প্রকাশ করেন যার নাম Yogoda Satsanga Lessons in Self-realization।
বহিসংযোগ
- Self-Realization Fellowship (SRF) website
- Yogoda Satsanga Society of India
- গুটেনবের্গ প্রকল্পে Paramahansa Yogananda-এর সাহিত্যকর্ম ও রচনাবলী (ইংরেজি)
- গুটেনবের্গ প্রকল্পে Autobiography of a Yogi by Paramahansa Yogananda'
সাধারণ | |
---|---|
জাতীয় গ্রন্থাগার | |
জীবনীমূলক অভিধান | |
বৈজ্ঞানিক ডাটাবেজ | |
অন্যান্য |