প্রতিদানহীন প্রেম
প্রতিদানহীন প্রেম বা একতরফা ভালোবাসা বা ব্যর্থ প্রেম (ইংরেজি: Unrequited Love বা One Sided Love অথবা Frustrated Love) হলো এমন এক ধরনের অনুরাগ যেটি স্পষ্টত দু'জন মানুষের মাঝে পারস্পরিক নয় অথবা যার প্রতি এই ধরনের প্রেমের অনুরক্তি থাকে, সে এই অনুরাগের বিষয়ে অবহিত নয় অথবা সজ্ঞানে সে এড়িয়ে চলে বা প্রত্যাখ্যান করে। ম্যারিয়াম ওয়েবস্টার অনলাইন অভিধান এই ধরনের প্রেমকে "পারস্পরিকবিহীন বা বিনিময়হীন" প্রেম হিসেবে অভিহিত করেছে। বাঙালি সমাজে 'একপক্ষ ভালোবাসা' শব্দটি একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ।
ফরাসী ঔপন্যাসিক মার্সেল প্রুস্তের মতে, "শুধুমাত্র প্রতিদানহীন প্রেমই হলো একমাত্র সফল ভালোবাসা"। কিন্তু অন্যদিকে মনঃচিকিৎসক এরিক বের্ন তাঁর "সেক্স অ্যান্ড হিউম্যান লাভিং" বইয়ে উল্লেখ করেছেন, "কেউ কেউ বলে সম্পর্কহীন জীবনযাপনের চাইতে একতরফা প্রেম শ্রেয়। কিন্তু একতরফা প্রেম অনেকটা রুটির অর্ধেক ডেলার মতো যেটি তৈরীতে দুরূহ হলেও খুব তাড়াতাড়ি বাসি হয়ে যায়"।
বিশ্লেষণ
প্রতিদানহীন প্রেমের কারণ
মনঃবিজ্ঞানী রয় বাওমেস্টারের মতে, যে বিষয়গুলো একজন পুরুষ বা নারীকে আকাংখনীয় করে তোলে, সেসব জিনিসগুলোর মাঝে অবশ্যই আছে জটিল এবং ব্যক্তিগত গুণাবলী ও বৈশিষ্টের সংমিশ্রণ। শারীরিক সৌন্দর্য্য, মাধুর্য, বুদ্ধিমত্তা এবং সামাজিক পদমর্যাদার মতো প্রভাবকের দরুণ একজন মানুষকে অন্যদের তুলনায় প্রাধান্য দেওয়ার হেতু যে প্রেমের উদ্ভব হয়, বাওমেস্টারের মতে প্রতিদানহীন প্রেমে জড়ানো মানুষদের মাঝে এই প্রভাবকগুলোর অনুপস্থিতিই তাকে এক-পেশে ভালোবাসার দিকে ধাবিত করে।
প্রতিদানহীন প্রেমের নেতিবাচকতা
অনুভূতি প্রকাশে অক্ষমতা এবং আবেগীয় চাহিদা পুরণের অপারগতা মূলত প্রতিদানহীন প্রেমে জড়িত মানুষদের বিষণ্ণতা, মৃদু আত্মবিশ্বাস, উদ্বিগ্নতা এবং মেজাজ-পরিবর্তন (বা মুড সুয়িং) এর মতো মানসিক জটিলতার দিকে পরিচালিত করে। রয় বাওমেস্টারের গবেষণানুযায়ী, আমাদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষই জীবনের কোন না কোন এক সময়ে প্রতিদানহীন প্রেমে নিজেদের জড়িয়েছি। প্রত্যাখ্যানের ফলে এই ধরনের প্রেমে একাকিত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি নিজেকে মূল্যহীন হিসেবে ভাবতে প্ররোচিত করে। যার ফলে এই ধরনের প্রেম মানুষদের মাঝে আত্মবিশ্বাস কমিয়ে আনে।
প্রত্যাখ্যানকারী
প্রতিদানহীন প্রেমের দুইটি পক্ষ আছে, কিন্তু শুধুমাত্র একটি পক্ষই আমাদের সংস্কৃতি কর্তৃক অধিক স্বীকৃত - আর সেটি হলো প্রতিদানহীন প্রেমে জড়িত প্রেমিক বা প্রেমিকা, প্রত্যাখ্যানকারী নয়। কিন্তু একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতিদানহীন প্রেমের ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যানকারীও সচরাচর অপরাধবোধে ভোগেন এবং "না" বলার ক্ষেত্রে তারাও হতোবুদ্ধি হয়ে পড়েন। কেননা ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যাখ্যানকারীরাও তাদের বিপরীত পক্ষের মানুষদের কষ্ট অনুধাবন করতে পারেন।
সাংস্কৃতিক প্রতিফলন
আধুনিক সংস্কৃতিতে প্রতিদানহীন প্রেম একটি বহুল আলোচিত বিষয়। চলচ্চিত্র, গ্রন্থ এবং গানে প্রায়শ প্রত্যাখ্যানকারীদের নিয়ে প্রতিদানহীন প্রেমে জড়িয়ে যাওয়া মানুষদের অনড় অবস্থান এবং ভালোবাসার মানুষদের প্রতি প্রতিদানহীন প্রণয়ী বা প্রণয়ীনীদের অনুভূতি চিত্রায়িত হয়ে এসেছে। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত "দ্য ডার্ক সাইড অব ক্লোজ রিলেশেনশিপ" (The Dark Side of Close Relationship) গ্রন্থে বইয়ের লেখক প্রতিদানহীন প্রেমে জড়ানো মানুষদের তাদের অবস্থানে অনড় থাকার কারণ উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু অন্যদিকে জার্মান আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস দ্য সরোজ অব ইয়ং ওয়ার্থার (The Sorrows of Young Werther) গ্রন্থে দেখা গিয়েছে প্রতিদানহীন প্রেমে জড়ানো প্রেমিকের আত্মহননের কাহিনী। এছাড়াও ব্রিটিশ লোকগীতি আই ওয়ান্স লাভ্ড এ লাস (I once loved a lass) গানেও প্রতিদানহীন প্রেম চিত্রিত হয়েছিলো।
ভাবা হয় প্লেটোনিক প্রেমই হলো প্রতিদানহীন প্রেমের মূল ভিত্তি প্রস্থর। অর্থাৎ প্লেটোনিক প্রেম থেকেই প্রতিদানহীন প্রেমের উৎপত্তি। প্রতিদানহীন প্রেম মূলত বন্ধু-মহল বা পরিচিত/পরিচিতা, কর্মস্থলে নিয়মিত সম্মুখীন হওয়া মানুষ, স্কুল কলেজ কিংবা অনেক মানুষের মিলনায়তনে কর্মক্ষেত্রের ঘটনাস্রোতে আলাপ হওয়া কোন ব্যক্তিদের মধ্যে সংগঠিত হয়ে থাকে। এই ধরনে প্রেমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিদানহীন ভালোবাসায় জড়িত ব্যক্তি অপ্রস্তুত অবস্থার সম্মুখীন হয় যেখানে ভালোবাসার মানুষটির প্রতি তাদের সত্যিকারের অনুভূতি তারা ভেতর থেকে প্রকাশ করতে অপারগ হন শুধুমাত্র প্রত্যাখ্যান, লোক-লজ্জা কিংবা চিরতরে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ভয়ে।
উপকারিতা
প্রতিদানহীন প্রেম সৃষ্টিশীলতার নেপথ্যে যুগ যুগ ধরে মানুষদের অনুপ্রেরণা যুগিয়ে এসেছে। বিখ্যাত ইতালীয় কবি দান্তে আলিগিয়েরি তাঁর সৃষ্টিশীলতার কারণ হিসেবে তাঁর বাল্যকালের পরিচিতা বিয়াত্রিস পোর্ত্রিনারির কথা উল্লেখ করেছেন। দান্তের সাথে বিয়াত্রিসের কখনো মন খুলে আলাপ না হলেও তিনি লা দিভিনা কমোদিয়া বা ডিভাইন কমেডি (Divine Comedy) এর মতো বিখ্যাত মহাকাব্যে বিয়াত্রিসকে আলোকবর্তিকা নারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি বিয়াত্রিসের মৃত্যুর পরে দান্তে তাঁর লা ভিতা নুওভা বা দ্য নিউ লাইফ (The New Life) রচনাতেও বিয়াত্রিসকে নিয়ে তাঁর অব্যক্ত এবং বিষাদময় প্রেমের কথা বর্ণনা করেছেন।
এছাড়াও, প্রতিদানহীন প্রেম সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি বর্তমানকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে এবং বাস্তবতার সম্মুখীন হতে শেখায়। কেননা সম্পর্ক তৈরীতে বিপরীত পক্ষের অনীহা কিংবা প্রত্যাখ্যানই মূলত প্রতিদানহীন প্রেমে জড়িত মানুষদের তাদের প্রেম-বিভ্রম থেকে ফিরিয়ে আনে।
প্রতিকার
রোমান কবি ওভিড তাঁর রেমোডিয়া অ্যামোরিস বা "লাভ'স রেমেডি" (Love's Remedy) কবিতায় প্রতিদানহীন প্রেম থেকে রেহাই পাওয়ার উপদেশ হিসেবে ভ্রমণ, মদ্যপান থেকে বিরত থাকা, গ্রামীণ জীবন পশ্চাদ্ধাবন এবং পরিশেষে রোমান্টিক কবিদের এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কিন্তু এই ধরনের এক-পেশে প্রেম থেকে রেহাই পাওয়ার প্রধান উপায় হলো এসব বিষয় থেকে নিজের চিত্তকে সরিয়ে আনা। ভিন্নধর্মী কোন কিছু শেখায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা অথবা স্বেচ্ছাসেবকমূলক কার্যকলাপে অংশীদারী হওয়া।
উদাহরণ
আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, ফরাসি লেখক স্টন্দল, ইতালীয় কবি দান্তে আলিগিয়েরি, রাশিয়ান-মার্কিনী উপন্যাসিক আয়ন রেন্ড, ড্যানিশ লেখক হান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন এবং জার্মান লেখক ইয়োহান ভোলফগাং ফন গ্যোটে প্রমুখ অনেক মনীষী জীবনে প্রতিদানহীন প্রেমের উপস্থিতির কথা স্বীকার করেছিলেন।