মূত্র তন্ত্র
| রেচন তন্ত্র | |
|---|---|
|
১. মানবদেহের মূত্র তন্ত্র: ২. বৃক্ক, ৩.রেনাল পেলভিস, ৪. ইউরেটার, ৫.মূত্রথলি, ৬. ইউরেথ্রা. (সম্মুখ তলের বাম পাশে)
৭. অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি রক্ত বাহিকা: ৮. রেনাল ধমনি এবং রেনাল শিরা, ৯. নিম্ন-মহাশিরা, ১০. উদরীয় মহাধমনি, ১১. সাধারণ ইলিয়াক ধমনি এবং সাধারণ ইলিয়াক শিরা স্বচ্ছ: ১২. যকৃৎ, ১৩. বৃহদান্ত্র, ১৪. শ্রোণী | |
|
পুরুষের মূত্র তন্ত্র। মূত্র বৃক্ক থেকে প্রবাহিত হয়ে ইউরেটারের মধ্য দিয়ে মূত্রথলিতে গিয়ে জমা হয়। মূত্রত্যাগের সময়, ইউরেথ্রার (পুরুষদের বড়, নারীদের ছোট) মধ্য দিয়ে মূত্র দেহের বাইরে বের হয়ে আসে।
| |
| বিস্তারিত | |
| শনাক্তকারী | |
| লাতিন | Systema urinarium |
| মে-এসএইচ | D014551 |
| টিএ৯৮ | A08.0.00.000 |
| টিএ২ | 3357 |
| এফএমএ | FMA:7159 |
| শারীরস্থান পরিভাষা | |
মূত্র তন্ত্র, এছাড়াও বৃক্ক তন্ত্র বা মূত্রনালি (ইংরেজিতে:urinary system, renal system বা urinary tract) নামেও পরিচিত, যা বৃক্ক, ইউরেটার, মূত্রথলি, এবং ইউরেথ্রা নিয়ে গঠিত। মূত্র তন্ত্রের কাজ হল শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ অপসারণ, রক্তের আয়তন, রক্তচাপ, বিভিন্ন আয়ন ও বিপাকজাত পদার্থের মাত্রা এবং রক্তের pH নিয়ন্ত্রণ করা। মূত্রনালি মূত্র অপসারণের জন্য শরীরের একটি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। মানুষের বৃক্ক দুটি ব্যাপক রক্তজালিকা সমৃদ্ধ। রেনাল ধমনি বৃক্কে রক্ত বহন করে আনে, আর রেনাল শিরা বৃক্ক থেকে রক্ত বহন করে নিয়ে যায়। প্রতিটি বৃক্কে গঠন ও কাজের একক হিসেবে রয়েছে অসংখ্য নেফ্রন। রক্ত পরিস্রাবণ এবং পরবর্তী প্রক্রিয়াজাতকরণের পরে, বর্জ্য পদার্থগুলো মূত্র হিসেবে মসৃণপেশী দিয়ে গঠিত ইউরেটার বা গবিনী নামক একপ্রকার নালির মাধ্যমে বৃক্ক থেকে মূত্রথলিতে আসে। মূত্রথলিতে মূত্র জমা হয়ে থাকে এবং পরবর্তীতে মূত্রত্যাগের সময় দেহ থেকে বের হয়ে আসে। নারী এবং পুরুষের মূত্র তন্ত্রের গঠন প্রায় একইরকম, কেবল তাদের ইউরেথ্রার দৈর্ঘ্যে পার্থক্য রয়েছে।
রক্তের পরিস্রাবণের মাধ্যমে বৃক্কে মূত্র তৈরি হয়।
একজন সুস্থ মানুষের বৃক্কে দৈনিক ৮০০ – ২,০০০ মিলিলিটার মূত্র উৎপন্ন হয়। এই পরিমাণটি তরল গ্রহণ এবং কিডনি ফাংশন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। পানি গ্রহণের পরিমাণ এবং বৃক্কের কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে এই পরিমাণের তারতম্য ঘটতে পারে।
গঠন
মূত্র তন্ত্র বলতে এমনসব গঠনকাঠামোকে বোঝায় যেগুলো মূত্র সৃষ্টি এবং ত্যাগের আগ পর্যন্ত সৃষ্ট মূত্র পরিবহনের সাথে জড়িত। মানব মূত্র তন্ত্রে উদর গহ্বরের পশ্চাৎ প্রাচীর এবং প্যারাইটাল পেরিটোনিয়ামের মাঝে মেরুদণ্ডের উভয় পাশে অবস্থিত একটি করে মোট দুটি বৃক্ক রয়েছে।
বৃক্কের কার্যকরী একক নেফ্রনের মধ্যে মূত্র তৈরি শুরু হয়। মূত্র এরপর সংগ্রাহী নালির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই সংগ্রহকারী নালিগুলো প্রথমে মিলিত হয়ে লঘু বৃতি গঠন করে। এরপর কয়েকটি লঘু বৃতি মিলিত হয়ে গুরু বৃতি গঠন করে। গুরু বৃতিগুলো রেনাল পেলভিসে গিয়ে মিশে। এখান থেকে মূত্র রেনাল পেলভিস থেকে ইউরেটারে প্রবাহিত হয়, যা মূত্রথলি পর্যন্ত মূত্র পরিবহন করে। পুরুষ এবং নারীদের মূত্রথলির মধ্যে শারীরস্থানিক পার্থক্য রয়েছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে ইউরেথ্রা মূত্রাশয়ের ত্রিকোণে অবস্থিত অন্তঃস্থ ইউরেথ্রা মুখ থেকে শুরু হয়, যা বহিঃস্থ ইউরেথ্রা মুখের মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকে এবং তারপরে প্রোস্ট্যাটিক, ঝিল্লিময়, বাল্বার এবং পেনাইল ইউরেথ্রায় পরিণত হয়। বহিঃস্থ ইউরেথ্রা কুহরের মধ্য দিয়ে মূত্র নির্গত হয়। নারীদের ইউরেথ্রা অনেক খাটো, যা মূত্রাশয়ের গ্রীবায় শুরু হয়ে যোনিপথে উন্মুক্ত হয়।
বিকাশ
মাইক্রোঅ্যানাটমি
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দেখা যায় মূত্রতন্ত্রটি ইউরোথেলিয়াম নামক একটি অনন্য আস্তরণে আবৃত থাকে, এটি এক ধরনের অবস্থান্তর এপিথেলিয়াম। অবস্থান্তর এপিথেলিয়াম বেশিরভাগ অঙ্গগুলোর এপিথেলিয়াম আবরণীর মত নয়, বরং চ্যাপ্টা এবং ফুলে যেতে পারে। ইউরোথেলিয়াম রেনাল পেলভিস, ইউরেটার এবং মূত্রাশয় সহ মূত্রতন্ত্রের বেশিরভাগ অংশকে আচ্ছাদন করে।
কাজ
মূত্রনালি এবং তার উপাদানগুলোর প্রধান কাজ:
- রক্তের আয়তন এবং গঠন ঠিক রাখা (যেমন- সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্যালসিয়াম ইত্যাদি আয়নের ভাারসাম্য রক্ষা)।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা।
- রক্তের pH ঠিক রাখা।
- বৃক্ক দ্বারা লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে অবদান রাখা।
- ক্যালসিট্রাইওল (ভিটামিন ডি এর সক্রিয় রূপ) সংশ্লেষে সহায়তা করে ।
- দেহ থেকে বিভিন্ন বিপাকীয় বর্জ্য (প্রধানত ইউরিয়া এবং ইউরিক এসিড ) অপসারণের আগে সঞ্চয় করে রাখা।
মূত্র সৃষ্টি
পানি গ্রহণের পরিমাণ, কায়িক পরিশ্রম, পরিবেশ, ওজন এবং ব্যক্তির স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ – ২ লিটার মূত্র সৃষ্টি হয়। খুব বেশি বা খুব কম মূত্র সৃষ্টি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। অত্যধিক মূত্র সৃষ্টি (> ২.৫ লিটার/দিন) হলে, সেই অবস্থাকে পলিইউরিয়া বলে। প্রতিদিন ৪০০ মিলিলিটারের কম উৎপাদিত হলে অলিগিউরিয়া এবং ১০০ মিলিলিটারের কম উৎপাদিত হলে তাকে অ্যানিউরিয়া বলে।
মূত্র সৃষ্টির প্রথম ধাপ হল বৃক্কে রক্তের অতি পরিস্রাবণ। সুস্থ মানুষে কার্ডিয়াক আউটপুটের ১২ থেকে ৩০% বৃক্কের ভিতর দিয়ে যায়, তবে এটি গড়ে প্রায় ২০% বা প্রায় ১.২৫ লিটার/মিনিট হয়।
ঘনত্ব এবং আয়তন নিয়ন্ত্রণ
মূত্র তন্ত্র সংবহন তন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র এবং অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
কিডনিতে প্রভাবের মাধ্যমে অ্যালডোস্টেরন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এটি নেফ্রনের দূরবর্তী প্যাঁচানো নালিকা এবং সংগ্রাহী নালির উপরে কাজ করে এবং গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট থেকে সোডিয়ামের পুনঃশোষণ বৃদ্ধি করে। সোডিয়াম পুনঃশোষণের ফলে জল ধারণক্ষমতা বেড়ে যায় যা রক্তচাপ এবং রক্তের আয়তন বাড়ায়। অ্যান্টিডাইউরেটিক হরমোন (ADH), বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায়। এর দুটি প্রাথমিক ভূমিকা হল শরীরে জল ধরে রাখা এবং প্রয়োজন মত রক্ত নালির সংকোচন (ভ্যাসোকন্সট্রিকশান) ঘটানো। ভ্যাসোপ্রেসিন নেফ্রনের সংগ্রাহী নালিগুলিতে জলের পুনঃশোষণ বাড়িয়ে শরীরের পানি ধরে রাখা নিয়ন্ত্রণ করে। ADH নেফ্রনের দূরবর্তী প্যাঁচানো নালিকা এবং সংগ্রাহী নালির প্লাজমা ঝিল্লিতে অ্যাকোয়াপোরিন-সিডি চ্যানেলগুলির ট্রান্সলোকেশনকে উদ্দীপ্ত করে দূরবর্তী প্যাঁচানো নালিকা এবং সংগ্রাহী নালিতে পানির ভেদনযোগ্যতা বাড়ায়।
মূত্র ত্যাগ
মূত্রথলি থেকে ইউরেথ্রার মাধ্যমে মূত্র দেহের বাইরে নির্গত হওয়াকে মূত্র ত্যাগ বলে। সুস্থ মানুষে (এবং অন্যান্য অনেক প্রাণীতে) মূত্রত্যাগ একটি ঐচ্ছিক ব্যাপার। শিশুদের, কিছু প্রবীণ ব্যক্তির এবং ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে মূত্র ত্যাগ একটি অনৈচ্ছিক প্রতিবর্ত হিসেবে দেখা দিতে পারে। শারীরবৃত্তীয়ভাবে, মূত্র ত্যাগ কেন্দ্রীয়, স্বয়ংক্রিয় এবং সোম্যাটিক স্নায়ুতন্ত্রের সমন্বয়ে নিয়ন্ত্রিত। মস্তিষ্কের যেসব কেন্দ্র মূত্রত্যাগ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের মধ্যে রয়েছে পন্টাইন মিকচুরিশান সেন্টার, পেরিঅ্যাকুইডাক্টাল গ্রে এবং সেরেব্রাল কর্টেক্স। অমরাবিশিষ্ট স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় পুরুষরা শিশ্নের মাধ্যমে এবং নারীরা স্ত্রীযোনিদ্বারের মাধ্যমে মূত্র ত্যাগ করে।
ক্লিনিকাল গুরুত্ব
ইউরোলজিক রোগ মূত্রতন্ত্রের জন্মগত বা অর্জিত কর্মহীনতার সাথে জড়িত থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মূত্রনালিতে বিঘ্ন একটি ইউরোলজিক রোগ যা মূত্রনালি থেকে মূত্র প্রবাহের অক্ষমতার কারণ হতে পারে।
কিডনি টিস্যুর রোগগুলি সাধারণত নেফ্রোলজিস্টদের দ্বারা চিকিৎসা করা হয়, আর মূত্রনালির রোগগুলি ইউরোলজিস্টদের দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা মাঝে মাঝে নারীদের মূত্রনালির রোগগুলির চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।